মুন্সিগঞ্জের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধ্বংসের আওয়াজ শুনি

মুন্সিগঞ্জের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধ্বংসের আওয়াজ শুনিঃ শ্রীনগরে ৪টি হাই স্কুলে এসএসসিতে পাশের হার সবচেয়ে কম, শতবর্ষী হরেন্দ্রলাল ও জে সি বোস স্কুলেও শিক্ষার মানে আছে শত বাধা (পর্ব-১)


আবু জাফর আহমেদ মুকুল

কয়েক মাস পূর্বে আমার এক বন্ধু সপরিবারে জগত বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈতৃক ভিটা রাঢীখালে ভ্রমনে করতে যায়। স্যার জে.সি বোস কমপ্লেক্স ঘুরে দেখেন প্রায় ভবনে বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা দূরের কথা বরংঞ্চ ভবনে বড় করে লেখা আছে ডাঃ জাহাঙ্গীর ভবন, আমির হোসেন ও মুনছুরুননেছা। তাই হঠাৎ করে আমাকে প্রশ্ন করে এটা স্যার জে.সি বোস কমপ্লেক্স না রেখে মুনছুরুননেছা কমপ্লেক্স রাখলে মানাতো কারণ তার নাম বেশ বড়।

এমনকি স্কুলটি ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রতিষ্ঠান প্রধানের বোর্ডে ২৬ জন প্রধান শিক্ষক/অধ্যক্ষ বাদ দিয়ে নিজের নাম এক নম্বরে বসিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এগুলো নিয়ে যাদের চিন্তা করার কথা তৎকালীন কমিটি নীরব ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার একটি অঙ্গীকার এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) একটি লক্ষ্য হলো-সকল স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা। শিক্ষার মান নির্ধারন করতে পারে প্রত্যেকটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বহিঃ স্থ শিক্ষাবিদ দ্বারা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকা জরুরি। মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ব্যক্তিক পর্যায়ে আয় বৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। তবে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে গেলে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করাটাও জরুরি। তাদেরকে বাদ রেখে উচ্চ শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা কখনোই সম্ভব নয়।

সুতরাং স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত মান সম্মত শিক্ষার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কড়া নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে অবস্থিত স্কুলেগুলোতে মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পৃথক কোন কমিটি অস্তিত্ব ও রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। এমনকি এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। সদ্য প্রকাশিত এসএসসির স্কুলের ফলাফলে অভিভাবক, ছাত্র, সচেতন নাগরিক, সংবাদকর্মী, স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষাবিদ সব পক্ষই অসন্তোষ লক্ষ্য করা যায়।

এ বছর শতবর্ষী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইনিস্টিটিউশন এন্ড কলেজ-এ SSC পরীক্ষা-২০২০ইং মোট পরিক্ষা দেয়-১১৯ জন, পাশ-৬৪ জন, জিপিএ-৫ একজন, পাশের হার-৫৩.৭৮% ও ভাগ্যকুল হরেন্দ্রলাল উচ্চ বিদ্যালয় মোট পরীক্ষা দেয়- ৩৬৩ জন, পাশ-২৬৪ জন জিপিএ-৫ তিনজন, পাশের হার ৭৫.৮৪%। এ বছর ফলাফলে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৮২.৩৪%। উপজেলায় প্রত্যন্ত স্কুলেও ৯০% এর উপর পাশ করেছে অথচ শ্রীনগর উপজেলা থেকে থেকে নিকটবর্তী এই ৪টি স্কুলে পাশের হার সবচেয়ে কম।

অথচ রাড়িখাল স্যার জেসি বোস ইনস্টিটিউশন থেকে উল্লেখযোগ্য যারা পাশ করেছিলেন তার মধ্যে প্রফেসর হুমায়ুন আজাদ, প্রফেসর রামেশ্বর মন্ডল, কন্ট্রোলার অব একাউন্টস এজি অফিসের আব্দুল আজিজ সিকদার, সোনালী ব্যাংক জিএম মাহবুব উল হক পান্নু, ভারতে পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে বড় দায়িত্ব ছিলেন বিশ্বনাথ দাস, পরিসংখ্যান ব্যুরোর অবঃ উপ- মহাপরিচালক আবদুর রশিদ সিকদার, ঢাকা সিটি কর্পোঃ উপ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোঃ হেলালউদ্দিন, বাসস, অবজারভার ও প্রেসক্লাবের সাংবাদিক নুরুল হুদা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুস সালাম পিএসসি অবঃ, অতিঃ সচিব মোঃ সাজ্জাদ কবির ও মোঃ সিরাজউদ্দীন খান ।

অন্যদিকে ভাগ্যকুল হরেন্দ্রলাল উচ্চ বিদ্যালয় বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সালমান এফ রহমানের পিতা ফজলুর রহমান খান, বর্তমান সংসদ সদস্য সানিজদা খানম, ডিআইডি আবুল কাশেম, সূর্য খান। অতীতে এই দুটি স্কুলে এতিহ্য, পাশের হার ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা হতো।

আর বর্তমানে এই অবস্থা যে, মানসম্মত শিক্ষাতো দূরের কথা বরংঞ্চ সারা দেশে এখন সবাই গণহারে পাশ করলেও এই শ্রীনগর উপজেলার শতবর্ষী স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাশের হার বাড়ছে না।

তবে আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই হাই স্কুলের সমস্যা ও সমাধানগুলো ইতিবাচক হিসেবে দেখবেন এবং সমাধানগুলো বাস্তবায়ন করে হাই স্কুলগুলোকে এগিয়ে যাবেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে আমি সত্যতা যাচাইপূর্বক স্থানীয় অভিভাবক, সচেতন প্রতিনিধি, প্রশাসন, সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের সাথে কথা বলে শ্রীনগর উপজেলার চারটি স্কুলের তুলনামূলকভাবে চিত্র তুলে ধরছি
যাতে স্কুল চারটি আগামিতে ভাল কিছু করতে পারেঃ

ক) স্যার জেসি বোস ইনস্টিটিউশনঃ সকল পক্ষের সাথে কথা বলে বুঝেছি, এ স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার নেই ও যথাযথ দায়িত্বের অভাব, কমিটির বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষার বিষয়ে অবচেতন, স্কুল ও কলেজের পৃথক প্রশাসক এবং ব্যবস্থাপনা না থাকা, স্থানীয় লেজুড়বৃত্তিমূলক লোকজনের আগমন বেশি, স্কুলের আয়ের কোন স্বচ্ছতা নেই, স্কুলের অ্যালামনাইদের সাথে নিয়মিত সভা করা হয় না, এক বিষয়ের পাসকৃত শিক্ষক অন্য বিষয়ে ক্লাস নেয়, অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে অযোগ্য প্রার্থী নিয়োগ, ছাত্রদের গাইডমুখী করা, অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি।

অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, ২০১৮ সালে সাবেক ইউএনও জাহিদুল ইসলাম যখন বুঝতে পারলেন এ স্কুল অন্য স্কুলের সাথে যোগসাজশে ভিজিলেন্স টিমকে আড়ালে রেখে বা ভয় দেখিয়ে দূরে সড়িয়ে রেখে স্ব স্ব স্কুলের পাশের হার ৯০ এর উর্ধে রাখার জন্য কাজ করাতেন। ২০১৮ সাল থেকে ভিজিলেন্স টিমকে সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালনে কড়াকড়ি করায় ফলাফল চিত্র স্বাভাবিক হতে শুরু করে অর্থাৎ গড়ে পাশের হার কমে ৫০ হতে থাকে।

কিন্তু মান বা জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে উন্নতি পরিলক্ষিত হয় নি। এরপর ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শতবর্ষী স্কুল দুটির প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। দিন দিন পাশের হার কমছে অথচ এটি এমপিওভুক্ত স্কুল ও কলেজ সরকারি টাকায় বেতন পেয়ে সবাই উদাসীন হয়ে পড়ছে। স্কুলের সাথে কলেজ থাকলেও কলেজ তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। কলেজের ক্ষেত্রে ছাত্ররা সরকারি শ্রীনগর কলেজ এবং দোহারের পদ্মা কলেজে ভর্তি হতে আগ্রহী।

তাই উপরোক্ত বিষয়গুলো নিম্নোক্তভাবে সমাধান করা যেতে পারেঃ


১) একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়। এগারো বছর যাবত ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন জাতীয় পর্যায়ের নেতা। তারা কেউ ইচ্ছে থাকলেও প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেয়া বা মনিটরিং এ সময় দিতে পারেন না। এখান থেকে স্থানীয় ও জাতীয় পদধারী সকল ধরনের রাজনৈতিক নেতা রাখা সমীচিত নয়। তাই স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি সংস্কার করা খুব প্রয়োজন।

২) সরকারের ইশতেহারে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্যে স্থানীয় স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ বা অবসরপ্রাপ্ত চাকুরিজীবি সমন্বয়ে প্রত্যেকটি স্কুলে আলাদা উপ-কমিটি গঠন করা।

৩) কমিটির ৬ জন সদস্যের মধ্যে ২ জন স্থানীয় অভিভাবক থেকে শিক্ষিত ও সচেতন অভিভাবক নির্বাচিত করা প্রয়োজন এবং শিক্ষক থেকে যে ২ জনকে নেওয়া হয় তা ১ জন বাইরে থেকে কোন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ নেওয়া যেতে পারে।

৪)ভপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা নির্ধারনের জন্য স্থানীয় সৎ ও শিক্ষিত লোক দ্বারা উপ-কমিটি নির্ধারন। প্রয়োজনে ১ মাস পর পর অডিট করা।

৫)স্যার জে.সি বোস কমপ্লেক্স এর আয়, পুকুরে মাছ চাষ ও আম বাগানের আয়ের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে টেন্ডার আহবান করা এবং টেন্ডার না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাগজ ও আয়ের রেকর্ড অফিসে সংরক্ষণ করা।

৬) স্কুলে ম্যানেজিং কমিটির প্রতি মাসে নিয়মিত সভা করা এবং প্রাক্তন ছাত্রদের নিমন্ত্রণ করে মান সম্মত শিক্ষার জন্য সাজেশন গ্রহন করা।

৭) কতিপয় শিক্ষক ক্লাসে পাঠদানের চাইতে টিউশনের জন্য বেশী মনোযোগী থাকেন এবং গাইড বইয়ের প্রতি গুরুত্ব বেশি দেয়। এ প্রবনতা দূর করা প্রয়োজন।

৮) মেধা বৃদ্ধির জন্য স্কুলে হোস্টেল বানিয়ে সেখানে রেখে রাতে অন্ততঃ চার ঘন্টা বই পড়ায় ব্যস্ত রাখতে পারলে জিপিএ-৫ বাড়ানো যেতো। এমনিক দুর্বল ছাত্রদের জন্য বিশেষ ক্লাস চালু করা প্রয়োজন।

৯) এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিষয়ের ক্লাস নিচ্ছে যার ফলে শিক্ষার্থীরা গুনগত শিক্ষার মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

১০) যে শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন, সে ওই ক্লাসের শিক্ষককে খাতা দেখতে না দেওয়া, প্রয়োজনে স্কুলে শিক্ষার মানের জন্য বহিঃস্থ শিক্ষক কর্তৃক খাতা মূল্যায়ন এবং পরীক্ষায় মডারেশন করে প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে প্রশ্নপত্র সংরক্ষন করা। সর্বোপরি, প্রত্যেক ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষায় খাতায় নামের পরিবর্তে কোডিং ব্যবহার করা।

১১) বিদ্যালয় এবং অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগের সমন্বয়হীনতা পরীক্ষার ফলাফল খারাপ করার অন্যতম কারণ। সুতরাং মোবাইলে একাডেমিক বিষয়ে মেসেজ সিস্টেম চালু করা প্রয়োজন। আর কোন শিক্ষার্থীদের অশিক্ষিত বা অসচেতন হলে তার পরিবারের বা আত্নীয়দের মধ্যে যে শিক্ষিত অভিভাবক হিসেবে তার মোবাইল নাম্বার সংযুক্ত করা।

১৩) কোন শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত হলে অভিভাবককে সাথে সাথে অবগত করা এবং ক্লাস থেকে ড্রপ আউট হলে সরাসরি তার বাসায় গিয়ে শিক্ষকদের কাউন্সিলিং করানো।
ক্যাম্পাসের ভেতর ক্যান্টিনের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের পলায়ন রোধ করা যায়।

১৪) বিজ্ঞানে ও আইটি বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া অথবা, যারা আছেন তাদেরকে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্পেশাল ট্রেনিং দিয়ে শুধু দক্ষ করে তোলা। প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়া যায়।

১৫)বউপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজারকে নিয়মিত একাডেমি সুপারভাইজ করার অনুরোধ করা এবং তার নিকট হতে শিক্ষকদের সম্পর্কে ফিডব্যাক নেওয়া।

১৬)প্রাক্তন শিক্ষার্থী যারা বিজ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এবং সমাজের সুশীল সমাজ বা অবসরপ্রাপ্ত চাকুরিজীবি বা স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ তাদের থেকে দক্ষ ও যোগ্যদের নিয়ে তাদের সুবিধামত সময়ে স্বেচ্ছায় দিনব্যাপী ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

১৭)।বোর্ড পরীক্ষার অস্বাভাবিক পরিবেশ। ২০১৭ সালে একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাঢ়ীখাল ও ভাগ্যকূল কেন্দ্র একটি অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে যেখানে প্রতিপক্ষ মনে করা হয় বিপরীত পক্ষের কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের। এতে শিক্ষার্থীরা একটা ভীতিকর পরিস্থিতিতে পরীক্ষা দেয় যার ফলে তারা তাদের স্বাভাবিক পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে পারে না।

১৮) টেস্টে ফেল করা শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষা দিতে অনুমতি না দেওয়া এবং অন্য স্কুলের ফেলকৃত শিক্ষার্থীদের এ স্কুল থেকে সুযোগ না দেওয়া।

১৯) স্থানীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করা।

২০) শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বৃদ্ধির জন্য অভিভাবক, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের লোকজন অর্ন্তভুক্ত করা। ছাত্রদের বিদেশী-মুখী ও ছাত্রীদের আগে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।


খ) ভাগ্যকুল হরেন্দ্রলাল উচ্চ বিদ্যালয়ঃ মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার প্রায় ১২৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাগ্যকূল হরেন্দ্রলাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ভাগ্যকূলের শিক্ষাবিস্তারে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডের কারণে ভাগ্যকূল ইউনিয়নের সচেতন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল হরেন্দ্রলাল উচ্চবিদ্যালয়। বোর্ডের পরীক্ষায় ফলাফলও ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল দেখে মনে হয় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে।

১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ গঠনের ক্ষেত্রে ১২ বছর ধরে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। আগের কমিটি, একতরফাভাবে পরিচালনার কারণে কোন প্রকার বিজ্ঞপ্তি ছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমেই বেশির ভাগ খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে। খণ্ডকালীন এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ক্লাসে যথার্থ পাঠদানে অক্ষমতার পাশাপাশি প্রাইভেট পড়ানোর তারা বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকেন এমন কথা অহরহ শোনা যায়।

এমনকি স্কুলের পূর্বের কমিটির বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। তাই বর্তমান কমিটির সভাপতি মাকসুদ আলম ডাবলু এর নেতৃত্বে কমিটি এই ৫২ জন খন্ডকালীন শিক্ষককে স্কুলের নিজস্ব আয় থেকে কতদিন বেতন দিতে পারবেন সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। বর্তমান কমিটির সভাপতিকে জমি দখলের হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন এবং তাঁর ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য স্কুলকে সময় দেওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বর্তমান কমিটিকে শিক্ষার বিষয়ে এলাকাবাসী তেমন তৎপর দেখে নাই বললে চলে।

আর একটি বিষয় স্যার জেসি বোস ইনস্টিটিউশন শিক্ষার্থীদের জরিমানা না করানো হলেও এখানে শিক্ষার্থীদের জরিমানা করা হয়। বর্তমান সভাপতি এগুলো প্রত্যাহার করার অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়ন করেননি। স্কুলের আয় বাবদ দোকান ভাড়া, ব্যাংক ভাড়া ও পুকুরে মাছ চাষের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে টেন্ডার আহবান করা এবং টেন্ডার না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাগজ ও আয়ের রেকর্ড অফিসে সংরক্ষণ করা।

আশা করি, উপরে উল্লেখিত স্যার জেসি বোস ইনস্টিটিউশনের জন্য সুপারিশগুলো এই স্কুলও বাস্তবায়ন করে আগামি বছর আরও বেশি ভাল ফলাফল করতে পারবে।

গ) মজিদপুর দয়হাটা কে, সি, ইনষ্টিটিউশনঃ এ বছর মজিদপুর দয়হাটা কে, সি, ইনষ্টিটিউশন-এ SSC পরীক্ষা ২০২০ইং মোট পরীক্ষা দেয় ১৪৩ জন, পাশ ৮৩ জন, জিপিএ-৫ কেউ পায়নি, পাশের হার ৫৮.০৪%. গ্রামীন ব্যাংকের রিপোর্টে এই এলাকাকে হতদরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমি স্থানীয় অভিভাবক, সচেতন প্রতিনিধি, প্রশাসন, সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের সাথে কথা বলে বুঝেছি এখানে শিক্ষা সহায়ক কোন পরিবেশ নেই।

অনেক দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে কিন্তু এ স্কুলে এদের কোন সংগঠিত ব্যবস্থা নেই। যারা দুর্বল ছাত্র আছে তাদের কোন কাউন্সিলিংবা বিশেষ কোন ক্লাসের ব্যবস্থা নেই। তবে অধিকাংশ অভিভাবক দরিদ্র ও শিক্ষার বিষয়ে কোন সচেতনতা নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে তার গ্রামের অভিভাবক হিসেবে মাননীয় এমপি জনাব মাহী বি চৌধুরিকে অবগত করেননি এবং সহযোগিতা জন্য কোন আলোচনা করেননি।

ঘ) কামারগাঁও আইডিয়াল হাই স্কুলঃ এ বছর কামারগাঁও আইডিয়াল হাই স্কুল-এ SSC পরীক্ষা ২০২০ইং মোট পরীক্ষা দেয় ৮৬ জন, পাশ ৩২ জন, জিপিএ-৫ কেউ পায়নি, পাশের হার ৩৭.২১%. এই স্কুলটি উপজেলায় ২৩টি স্কুলের মধ্যে ২৩-তম। বলতে পারেন নিচের দিক থেকে প্রথম। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত একজন প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হিসেবে স্বৈরতান্ত্রিক বা স্বেচ্ছাচারিতা মনোভব অনুশীলন করছেন।

স্থানীয় প্রশাসন জানলেও এ বিষয়ে সভাপতি নির্বাচনের কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন গনতান্ত্রিক পরিবেশ নাই। শিক্ষকগণ তার বিরুদ্ধে উচিত কথা বলতে খুব ভয় পান এবং এমনকি কর্তৃপক্ষ কথায় কথায় চাকুরিচ্যুত করেন। তাই বাধ্য হয়ে, এখনকার শিক্ষকগণ তার প্রতি অনুগ্রহ হয়ে কাজ করছেন। শিক্ষকসংখ্যা কম হলেও খন্ডকালীন শিক্ষকদের যোগ্যতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এখানে মোটামোটি ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার কোন অনকূল পরিবেশ নাই বললেও চলে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রীনগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সুরাইয়া আশরাফী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক না থাকায় মেসেঞ্জার একটি Group খুলে এডুকেশনাল আইসিটি ফোরাম, শ্রীনগর তৈরি করে স্কুলের শিক্ষকদের একাডেমিক জ্ঞান শেয়ার করার সুযোগ তৈরি করছেন এবং হেড মাস্টারস্ Group করেছেন যার ফলে স্কুলের শিক্ষকগণ উপকৃত হচ্ছেন বলে জানা যায়।

এই উদ্যোগটি ‍খুব প্রশংসনীয়। তবে, প্রতিটি স্কুলের জন্য সরকারের মান সম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য কমিটির বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি পুরো উপজেলায় স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি লোকজন মান সম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের কাজের চেয়েও পদ-পদবী নিয়ে বেশি ব্যস্ত এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্কুলের শিক্ষার থেকে আয়ের টাকার দিকে তাদের নজর বেশি। উপজেলায় বিজ্ঞানের দক্ষ শিক্ষক না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীরা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন না যা খুবই দুঃখজনক বিষয়।

শিক্ষা জাতীয় মেরুদন্ড। আর এই মেরুদন্ডে যদি সমস্যা থাকে তাহলে সমগ্র জাতি বিপথে পরিচালিত হবে। যার ফলে আগামীর ফলাফল হবে ভয়াবহ। আর কেউ যদি বলে থাকে স্কুলগুলোর মান বাড়ছে তাহলে দেখবেন তাদের ছেলে-মেয়ে ওই স্কুলে পড়ছে না। সুতরাং যে স্কুল সিস্টেম আমরা মানছি না সেই স্কুলগুলোর মান বাড়বে কিভাবে?

শ্রীনগরে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা শয্যাশায়ী রোগীর মতো আমাদের শিক্ষার মানও নানা রোগে-শোকে ভোগে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে লাইফ সাপোর্টে চলে গেছে—এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে শুধু দাফন-কাফন নয়, শিক্ষার মানের কুলখানি হতেও বেশিদিন সময় লাগবে না। একটি সময় আসবে সরকার মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একজন সেনা অফিসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করবেন। নিশ্চয়ই এটি যদি করা হয়, স্কুলের শিক্ষকদের জন্য অবশ্যই সম্মান বয়ে আনবে না। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্য নেতৃত্বের জন্য স্থানীয় স্থানীয় প্রশাসনকে অবশ্যই বিবেচনা করা প্রয়োজন।

অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাই, বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিমূলক নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পদ্ধতি চলছে তা নিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নতো দূরের কথা, দেশে কোন স্তরে মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার মানোন্নয়নে ও শিক্ষা বিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে সরকার ও আমাদের সকলের কাজ করতে হবে।

তবুও এখানে টিকে আছে নেতৃত্ব, বেঁচে আছে আশার প্রদীপ। এখানকার ছাত্ররা স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর, স্বপ্ন দেখায় সুন্দর আগামীর বাংলাদেশের। অবশেষে আমার প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্রাচার্যের ছাড়পত্র’কবিতার দুটি লাইন দিয়ে সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল হবার জন্য অনুরোধ করছিঃ

বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।


লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ।

Scroll to Top