শিক্ষার মান: বিশ্ববিদ্যালয় ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে প্রশাসক হতে পারেন কারা? (পর্ব-২)

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


ভারতের ও.পি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. সি.রাজ কুমারের একাডেমিক যোগ্যতা দেখলাম। সে University of Oxford থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি, Harvard University থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি, University of Hong Kong থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন । তার পাসকৃত প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিউএস র‌্যাংকিং অবস্থান ১৫০।

অন্যদিকে যে পাকিস্তানকে নিয়ে আমরা উপহাস করি সেখানকার Lahore University of Management Sciences নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এর নাম প্রফেসর ড. আরশাদ আহমেদ। তিনি এমবিএ এবং পিএইচডি ডিগ্রি করেছেন কানাডার ম্যাকগ্রিল ইউনিভার্সিটি থেকে। তিনি কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি এবং কনোর্ডডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিটিং প্রফেসর। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিউএস র‌্যাংকিং ২০০, এমবিএ র‌্যাংকিং বিশ্বে ২৫-তম।

আমি নিশ্চিত, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ছাড়া বাংলাদেশের কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বা শিক্ষক হিসেবে আবেদন করলে সবার আগে তারা বাদ পড়তো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয় রাজনীতি শিক্ষাগত মানের ওপর প্রভুত্ব করছে। সুতরাং সরকারকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে যোগ্য লোক নিয়োগ প্রদান না করতে পারলে মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভালো ফলের শিক্ষার্থীই গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁদের বাদ দিয়ে দলীয় বিবেচনায় ‘ভোটার নিয়োগের প্রবণতা দিন দিনই বাড়ছে। নিয়োগের প্রথম পর্যায় প্রভাষক পদে নিয়োগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে এ বিষয়ে নিয়োগপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। দলগত ও আঞ্চলিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিভাগে পাস করা শিক্ষার্থীদের ওই বিভাগে চাকরি দেওয়ার প্রবণতা বদলাতে হবে।

একুশ শতকের উপযোগী শিক্ষা ও উন্নয়ন সহায়ক মানবসম্পদ তৈরিতে শিক্ষার মান উন্নয়ন ও গুণমানের দিকে ‘সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। উচ্চশিক্ষার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মানের নিম্নগতি। দেশে প্রতি বছরই এসএসসি ও এইচএসসিতে পাসের হার বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী মান বাড়ছে না বলে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে।

ধরা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ম্যানেজমেন্টে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করল। কিন্তু ম্যানেজমেন্টে আধুনিক উদ্ভাবন, নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে তার ধারণা নেই। এমনটি হলে তো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে না। কতিপয় নীতি-নির্ধারক বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষার উন্নয়নে বাংলাদেশ রোল মডেল। আর যদি তাই নয় তাহলে আপনাদের ছেলে-মেয়ে সরকারি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়িয়ে কেন বিদেশে পড়ান?

নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা শয্যাশায়ী রোগীর মতো আমাদের শিক্ষার মানও নানা রোগে-শোকে ভোগে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে লাইফ সাপোর্টে চলে গেছে—এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে শুধু দাফন-কাফন নয়, শিক্ষার মানের কুলখানি হতেও বেশিদিন সময় লাগবে না।

আপনারা ইতোমধ্যে জানেন যে, বাংলাদেশে একসময় সরকারি মেডিকেলগুলো অনেক অব্যবস্থাপনা ছিল। পরবর্তীতে সরকার প্রত্যেকটি মেডিকেলে একজন আর্মি অফিসার পরিচালক হিসেবে নিয়োগে প্রদান করে। আমরা দেখেছি, সরকারি মেডিকেলগুলোতে কিছুটা ব্যবস্থাপনার চিত্র পরিবর্তন হয়েছে।বিশেষত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অসাধারন কাজ হয়েছে।

এছাড়াও সামরিক বাহিনীর অধীনে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আর্মি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বাউয়েট), বাংলাদেশ সেনা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আর্মড ফোসড মেডিকেল কলেজ অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

ধরেন, উচ্চ শিক্ষার মান সম্মত করার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি), অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল ও ইউজিসি চেষ্টা করে ব্যর্থ হল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা করার জন্য কী ধরনের প্রশাসক সরকার নিয়োগ দিতে পারেন?

একটি সময় আসবে যখন দেখবেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন মেজর জেনারেলকে উপাচার্য, একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী সচিবকে উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার হিসেবে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং রেজিস্ট্রার হিসেবে একজন যুগ্ন-সচিবকে নিয়োগ প্রদান করা হবে। নিশ্চয়ই এটি যদি করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য অবশ্যই সম্মান বয়ে আনবে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য নেতৃত্বের জন্য সরকারকে অবশ্যই বিবেচনা করা প্রয়োজন।

আমি বলছি না, আপনাদের সরকারি দলের সমর্থকের বাইরে কাউকে নিয়োগ দিতে হবে। বরংচ সরকারি দলের সমর্থক তথা নীল দলের শিক্ষকদের মধ্যে একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্মত শিক্ষা কিছুটা এগিয়ে যাবে। অন্যথায় সরকারি কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের দোষ দিয়ে ভিন্নরকম আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চাপিয়ে দিবে।

বিশ্বজনীনতার যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নয়ন হচ্ছে। প্রতি বছর সফটওয়্যার নতুন ভার্শন, নতুন নতুন প্যাকেজ ও টুল বের হচ্ছে। এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সর্বশেষ আর্টিকেল, বই, রিপোর্ট সম্পর্কে অবগত না থাকলে আমাদের গবেষণার মান উন্নত হবে না।

আমাদের দুর্ভাগ্য, অনেক বিভাগের শিক্ষকই শিক্ষকতা শুরুর দিকেই কেবল বিভাগের নোটপত্র তৈরি করেন, অথবা তার ছাত্রকালীন নোটই ক্লাস নেওয়ার জন্য ব্যবহার করেন। এভাবে চলতে থাকে বছরের পর বছর। ফলে তার জ্ঞানের গভীরতা ও পরিধি যেমন বাড়ে না, তেমনি শিক্ষার্থীরাও বঞ্চিত হয় প্রাগ্রসর জ্ঞানের সংস্পর্শ থেকে।

আমরা যেমন খাবার কিনতে গেলে বলি অমুক কোম্পানির খাবার ভালো। আবার বাজারে নতুন কিছু এলে চিন্তা করি, নেব কি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেলায়ও বিষয়টি সে রকমই। অদূর ভবিষ্যতে চাকরির ইন্টারভিউতে বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। বলা হবে, বিশ্ববিদ্যালয়টি আইএসও সার্টিফায়েড, সুতরাং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্রগণ্য। অথবা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিউএস রেটিং দেখে শিক্ষার্থীদের চাকুরির জন্য ডাকা হবে।

আশা করি, সকল শিক্ষক শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সম্মত শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাববে এবং সরকারও এগিয়ে আসবেন।


তথ্যের উৎসঃ বিভিন্ন শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা সভা।

লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ।

Scroll to Top