৬ দফা থেকে স্বাধীনতা, জবি শিক্ষার্থীদের ভাবনা

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ


১৯৬৬ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য অবসানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ‘মুক্তির সনদ’ ৬ দফা নিয়ে রাজপথে নেমেছিল বাঙালি। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ডাকা এক জাতীয় সম্মেলনে পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ৬ দফার পক্ষে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু করেন এবং বাংলার আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে জনগণের সামনে ৬ দফার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। বাংলার সর্বস্তরের জনগণ এই ৬ দফা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করে এবং ৬ দফার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায়।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবি আদায়ে ঢাকাসহ সারা বাংলায় আওয়ামী লীগের ডাকে হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে সৈন্যদের গুলিতে মনু মিয়া, সফিক ও শামসুল হকসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। গ্রেপ্তার হন অনেকে। এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আপসহীন সংগ্রামের ধারায় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে যায় পরাধীন বাঙালি জাতি। পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক ৬ দফাভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই ধাপে ধাপে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয়।

৭ জুন ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস। বাঙালীর ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তির সনদকে কিভাবে দেখছে বর্তমান প্রজন্ম? সেটাই জানাতে ৬ দফা নিয়ে নিজেদের চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেছেন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী এস.এম নাদিম মাহমুদ বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধ এর মাধ্যমে পেয়েছি আমাদের আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও আরও অনেক মানুষের আত্নত্যাগ এর বিনিময়ে পেয়েছি এই স্বাধীনতা। মূলত এই যুদ্ধের এর বীজ আরো অনেক আগেই রোপন করা হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর  রহমান  পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন।আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে ২৩ মার্চ।

১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সম্বলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেলরাষ্ট্র ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই ফেডারেলরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।

এছাড়াও  ছিল  কেন্দ্রীয়  সরকারের ক্ষমতা,মুদ্রা ও অর্থ সমন্ধীয় ক্ষমতা,রাজস্ব, কর বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা, বৈদেশিক বানিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা,আঞ্চলিক  সেনাবাহিনী  গঠনের ক্ষমতা সম্পর্কে  বিস্তারিত। এই ৬ দফা দেশে অসামান্য জাগরন সৃষ্টি করে, গ্রামেগঞ্জে এর বার্তা পৌছেঁ যায়।প্রতিটি  বাঙালি অন্তরে ধারন করেছিলো এই ৬ দফা। এই ৬ দফার প্রভাব পরেছিল পুরো  মুক্তিযুদ্ধে। ছয় দফা দেওয়া না হলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হতো না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকেই সৃষ্টি হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান । এই গণঅভ্যুত্থান এর ফলেই বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার এর পরেই সত্তরের নির্বাচন হয় ।

সত্তরের নির্বাচন না হলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। আর মুক্তিযুদ্ধ না হলে দেশ স্বাধীনও হতো না। এই ৬ দফাই ছিলো আমাদের মুক্তির  সনদ। এই ৬ দফাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীজ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো। যার কারনেই আমরা পেয়েছি আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।”

পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক লিখেছেন, “৬ দফাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে একটি টার্নিং পয়েন্ট। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিকজান্তারা যেভাবে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলা শুরু করেছিল, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগের ডাকে পূর্ব বাংলায় হরতাল চলাকালে পুলিশ ও ইপিআর নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালায়।

এতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, মুজিবুল হকসহ অনেকে শহীদ হন। বাঙালী জাতি ক্ষোভে ফেপে ওঠে। স্বায়ত্তশাসন ছাড়া যে বাঙালি জাতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই তা বুঝতে কষ্ট হয়নি বাঙালীদের। ফলে গণআন্দোলন বেগবান হয়, যা আর কারও পক্ষেই রোধ করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।”

একাউন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিদ ফাইয়াজ লিখেছেন, “৬ দফাকে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তিসনদ বলে উল্লেখ করেন। ৬ দফার শেষ দফায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেন।  দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তৃতার শুরুটা ছিল এমনঃ ‘আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ৬ দফা কর্মসূচি দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি।’ পাকিস্তানি সামরিকজান্তাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে নিয়ে ছয় দফা প্রণয়ন করা হলেও ছয় দফার সংগ্রাম ছিল কণ্টকাকীর্ণ।

পাকিস্তানি শাসকরা এটিকে ভালো দৃষ্টিতে দেখেনি। বঙ্গবন্ধুকে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে বন্দি করে। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা জারি করা হয়। তবে ৬ দফার ফলে পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়, পাকিস্তানের দুইঅংশের বৈষম্য। বহুকাল থেকে অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের শিকার বাঙালী জাতি নতুন দিক নির্দেশনা পেয়েছিল। মানুষ বুঝতে পারে সামরিকজান্তার শাসনে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব না। প্রবল প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গবাসী। এরপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের চাপে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। মুক্তি মেলে বঙ্গবন্ধুর। যার ফলস্রুতিতে পতন হয় আইয়ুব খানের।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সায়ত্ত্বশাসন চেয়েছিলেন। ৫ বছরের ব্যবধানে আমরা পাই স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ।”

Scroll to Top