অনুপ্রেরণা ও ভালো মানুষ হওয়ার মূলমন্ত্র

অনুপ্রেরণা ও ভালো মানুষ হওয়ার মূলমন্ত্র

ড. মাহাদী হাসান


শুনো ভাই ও বোনেরা-
-ছোটবেলায় আমাদের উপর কারো কুনজর পড়বে সেই ভয়ে আমাদের মা আমাদের কপালের একপাশে নিকষ কালো ফোটা দিয়ে রাখতেন। কত্ত ভালোবাসেন মা আমাদের। বিশ্বের আর কোন দেশে এমন মা আছেন?

-আমাদের মা যখন আমাদের ব্রেস্টফিডিং করাতেন, তখন কারো সামনে করাতে চাইতেন না। কেউ দেখলে যদি আমাদের পেটে অসুখ হয় সেই ভয়ে। এমন মা বিশ্বের কোথায় মিলবে?

-ছোট্র বেলায় যখন অন্যরা কোলে নিতেন, এমনকি যদি বাবাও নিতেন কোলে, আমাদের মা বলতেন, সাবধানে নিও/নিস যেন ব্যাথা না পায়, পড়ে না যায়। আহারে ভালোবাসা!

-ভাইয়েরা বোনেরা, যখন বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলোনা, সারারাত মা না ঘুমিয়ে বাঁশের/তালপাতার পাখায় বাতাস করতেন। মা সারারাত না ঘুমিয়ে বা আধোঘুমে আবার তার দিনশুরু করতেন সকালে। এমন মা কোথায় পাবো?

-যখন একটু বড় হলাম আমরা। হাটতে শিখলাম। মধ্যবিত্তদের ঘরে তখন ওয়াকার ছিলোনা। আমাদের মায়েরা সেসময় ওয়াকার শব্দটিও শুনেনি। তোমার আমার হাটার সুবিধার্থে/যেন পড়ে ব্যথা না পাই, দুইটা বাঁশ দিয়ে ওগুলো ধরে হাটা শিখিয়েছেন। এমন মায়ের ভালোবাসা কোথায় পাওয়া যাবে?

-ওহে ভাইবোনেরা, যখন ছোট্র ছিলাম, যখন নিজের প্যান্ট নিজে পরতে পারতামনা, তখন মা গোসল করাতেন। শীতের সময় আমাদের জন্য গরম পানি করতেন চুলায়। মা নিজে ঠা-া পানি দিয়ে গোসল করলেও আমাদেরকে গরম পানিতেই গোসল করাতেন। ওই পানি বেশি গরম কিনা তা মায়ের হাতে ঢেলে পরীক্ষা করেই আমাদের গায়ে পরে ঢালতেন এমন স্যাক্রিফাইসিং মা কোথায় পাবে?

-ভাইবোনেরা, শীতকালে আমাদেরকে উষ্ণতা দেয়ার জন্য মা তার সুতি শাড়ির পুরোটাই ভিজিয়ে ফেলতেন। সেই ভেজা শাড়িতেই মা ঘুমাতেন। এমন মমত্ববোধ আর কোথায় পাবে? এই মমত্ববোধ তোমায় মোটিভেইট করেনা?

-যাদের বড় ভাইবোন ছিলো, সেই ভাইবোনেরা স্কুলের টিফিনের টাকা জমিয়ে আমাদের জন্য চকলেট কিংবা বাঁশের বাঁশি নিয়ে আসতো। এমন ভাইবোনের ভালোবাসা তোমায় মোটিভেইট করেনা?

-যখন ছোট্র ছিলাম, আমাদের নাম যাই রাখা হোক, আমাদের মা বাবা ভাইবোনেরা কত্ত আদুরে নামে আমাদের ডাকতেন সোনা, যাদু, ময়না, টিয়া, আব্বু, বাজান, আম্মু, মা, মামনি, লক্ষী। এসব মনে হলে জীবনের প্রতি ইন্সপায়ারড হও না?

-এখন ছোটদের দাঁত পড়ার সময় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের মা বাবা গল্পের তালে তালে একটানে ব্যথাহীনভাবেই দাঁত তুলে ফেলতেন। মনে পড়ে সেই সেরা ডাক্তারদের কথা?

-যখন স্কুলে যাবার বয়স হলো, মা নিজের কোলের কাছে আমাদের মাথা নিয়ে জড়িয়ে ধরে কি গভীর ভালোবাসায় চুল ঠিক করে দিতেন কিংবা বোনদের চুলে বেণি করে দিত মনে পড়ে? মা আমাদের মাথায় বেশি করে তেল দিয়ে দিতেন। সেই তেল কানের দুপাশ বেয়ে পড়তো! আহা মনে হতো মাথা থেকে মমত্ববোধ পড়ে যাচ্ছে মনে পড়ে সেসব?

-হে আধুনিক প্রজন্ম, তোমাকে এক জোড়া জুতা কিনে দিয়ে তোমার বাবা কতদিন খালি পায়ে হেটেছেন, তার হিসেব রেখেছো? তোমাকে একটা গাইড বই কিনে না দেয়ায় তোমার মা তোমার বাবাকে কত্ত বকেছেন! তোমার বাবা কোন অভিযোগ করেননি। মনে পড়ে?

-যারা প্রত্যন্ত গ্রামে বড় হয়েছো আমার মতো, একটা হারিকেনের আলোয় কিংবা পিদিমের আলোয় পড়তে। আমাদের মা হারিকেনের চিমনির সাথে একটা সাদা কাগজ লাগিয়ে দিতেন যেন আমাদের চোখেমুখে বেশি উত্তাপ না লাগে। আহা ভালোবাসা!

-মনে পড়ে, পড়ার আওয়াজ একটু কমে গেলেই মা কিংবা বাবা পেছনের রুম থেকে আওয়াজ তুলতেন, “পড়তেছনা কেন? শব্দ করে পড়। শুনতে পাচ্ছোনা পাশের বাড়ি থেকে পড়ার আওয়াজ আসতেছে!” এমন আরো কত কি মনে পড়ে মায়ের সেই স্বর?

-পাড়ার অপেক্ষাকৃত কম ভালো কিংবা স্কুল পালানো ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে কতবার না করতেন আমাদের মা বাবা? কয় লক্ষবার আমাদেরকে খারাপের সাথে মিশতে না করেছেন? মনে পড়ে?

-পেটভরে খাওয়ার পরেও বাবা-মা বলতেন, “আজকে তোমার ক্ষিধে নেই কেন? রাস্তার দোকানের খাবার খেয়েছো নিশ্চয়ই।” মনে পড়ে?
-অন্যের গাছের ফল কিংবা পুকুরের মাছ কিংবা অন্যের খেলনা সামগ্রী নিয়ে আসলে মা সেসব রেখে আসতে বলতেন। মা আমাদের সৎপথের কথা বলতেন। সেই সততার শিক্ষা মনে পড়েনা?

-প্রাথমিকে কিংবা মাধ্যমিকে স্কুলের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, একটা দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার জন্য মা কত্ত অনুপ্রেরণা দিতেন, সেসব মনে পড়ে? ছেলেমেয়েরা গান গাইবে কিংবা লং জাম্প দিবে, তা দেখার জন্য বাবা মা স্কুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একটা পুরস্কার পেলে সেদিনের সব অকাজের জন্য আর শাস্তি দিতেন না। সেসব মনে পড়ে?

-হে প্রজন্ম তুমি কি জানোনা, তোমাদের মসজিদে পাঁচবেলা আযান দেয়া মুয়াজ্জিন কিংবা মন্দিরে প্রতিদিন ঘন্টা বাজানো লোকটা কত্ত অল্প টাকা পেয়েও সততার সাথে জীবন যাপন করছে? তার কাছ থেকে মক্তবে কিংবা মন্দিরে আল-কোরআন কিংবা গীতা থেকে যেসব শিখেছিলে, সেই শিক্ষা কোথায় আজ?

-তোমাদের বোঝা বইতে বইতে আমিন মিয়ার কাধে ফোসকা হয়েছে, তার জন্য তোমার কিছুই করার নেই আজ? ভেবে দেখো কার টাকায় তুমি আজ মহারাজা? তোমাকে কবির ভাষায় জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়-

“রাজা, তোর কাপড় কই?”
-মনে পড়েনা স্কুলে প্রতিদিন একটা শার্ট পরে আসা মাস্টার মসাই পড়াতেন, “সকালে উঠে আমি মনে মনে বলি, সারাদিন যেন আমি ভালো হয়ে চলি”। খবর রাখো সেই শিক্ষাগুরুর?

-হে প্রজন্ম মনে কি পড়েনা, অন্যের গায়ে হাত দেয়ার অপরাধে হেডমাস্টার সাহেব কয়টা বেত ভেঙেছে তোমার পিঠে? আহা শাসন।
-হে প্রজন্ম মনে পড়ে কি, সেই যে ক্লাস শুরুর আগে হাজারো শিক্ষার্থী মিলে গাইতে, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”?
-হে গ্র‌্যাজুয়েট, ক্যাডার, ব্যাংকার, শিক্ষক, ডাক্তার, ডক্টর ভাইবোনেরা, মনে পড়ে স্কুলে সবার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে/মেয়ে উচ্চকন্ঠে প্রতিদিন শপথবাক্য পাঠ করাতো- “আমি শপথ করিতেছি যে, বাংলাদেশের সেবায়…”? বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সব ভুলে গেছ?

-মনে পড়ে, তোমরা কয়েকশোজন একসাথে হাততুলে জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে? ভুলে গেলে আরেকবার স্কুলের শুরুতে যাও। সব মনে পড়বে।
-হে প্রজন্ম, মনে পড়েনা, সেসব কবিতা, “সবার সুখে হাসবো আমি, কাঁদবো সবার দুঃখে” কিংবা “আমি হবো সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি”? ভুলে গেছো? তুমি কি জাগবেনা আজ?

মা বাবার এত্তসব অনুপ্রেরণা, ভালোবাসা, স্কুলের শপথ আর নৈতিকতার শিক্ষা যেদেশের ছেলেমেয়েরা বাচ্চাকাল থেকেই পেয়ে থাকে, তাদের এখন মোটিভেশনাল স্পীচ শুনতে হয় টাকা দিয়ে। তাদের এখন প্রেরণার জন্য বিভিন্ন মুভি দেখতে হয় তাদের নৈতিকতা আর দেশপ্রেম শেখাবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলেও এথিক্স ও বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়াতে হয়।

আমি বলছিনা মুভি দেখে প্রেরণা নেয়া কিংবা এথিক্স বা বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়ানো খারাপ। জানার জন্য পড়া যায়। কিন্তু যে শেকড় ভুলে যায়, এসব ক্লাসরুমের শিক্ষায় তার কতটুকুই বা উন্নতি হয়?

শুনো প্রজন্ম,
তোমার মায়ের মমত্ববোধ, ভাইবোনের ভালোবাসা, স্কুলের নৈতিকতার শিক্ষা- এসবে যদি তুমি অনুপ্রাণিত না হও, যদি ভালো মানুষ না হও, তাহলে পৃথিবির দ্বিতীয় কোন শক্তি তোমাকে মোটিভেট করতে পারবেনা। হোক তা ভালো ফলাফলের জন্য কিংবা ভালো মানুষ হওয়ার জন্য।

এই নষ্ট বর্তমানে প্রেরণা খুঁজোনা।
এই নষ্ট বর্তমানে ভালো হওয়ার দীক্ষা খুঁজোনা।
এখানে তুমি এসব নাও পেতে পারো।

তোমার প্রেরণা ও ভালো হওয়ার দীক্ষা-
তোমার অতীতে।
তোমার বাল্যশিক্ষায়।
তোমার মায়ের সেই ভিজা আঁচলে।
তোমার বাবার খালি পায়ে হাটার শব্দে।
তোমার ভাইবোনের এনে দেয়া চার আনার চকলেটে।
তোমার মা বাবার আজ্ঞায়।
তোমার মা বাবার নিষেধাজ্ঞায়।
স্কুল মাস্টারের বেতের আঘাতে।
স্কুল মাস্টারের সেই ভালোবাসায়।
বাড়ির কামলামুনিদের কোলের স্পর্শে।

বর্তমান তোমাকে দাসে পরিণত করবে। তোমাকে হিপোক্রিটে পরিণত করবে যদি তুমি তোমার শেকড়কে ভুলে যাও।

তাই প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু থেকেই প্রেরণা নিও।
তোমাকেই এদেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
তুমি যদি হেরে যাও, তাহলে পরের প্রজন্ম “ভালো মানুষ হও”, নৈতিক হও”, “দেশকে ভালোবাসো”, “কারো উপর জুলুম করোনা”- এসব শিক্ষাকে গালি মনে করবে। তাই আমরা দায়িত্ব না নিলে, আমাদের সম্মুক্ষে আরো বেশি হতাশা অপেক্ষা করছে ধরে নিতে হবে।

ভুল জায়গায় প্রেম খুঁজোনা।
ফিরে যাও তোমার মূলে।
তোমার মূলেই তোমার কূল।

নজরুলের ভাষায় আবারো গেয়ে উঠো,

“ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!

ফাঁসির মে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসিথ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!”

লেখক ও শিক্ষক,
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *