অব্যক্ত গল্প | তাজমিন রহমান

অব্যক্ত গল্প | তাজমিন রহমান

অব্যক্ত গল্প
তাজমিন রহমান


পারমিতা শুনছো,
তোমাকে কিছু বলার ছিল
যা একান্তই গোপনীয়
শুধু তোমাকেই বলা যায়,
ভরসা করা যায়।

দীর্ঘ ১৬ বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছি
চুকিয়ে দিয়েছি সব দায়ভার ।
সম্পর্কটা প্রেমের ছিল নাহ,
সম্পর্কটা ছিল আত্মার।
ভাবছো এমন হলো কেন??
তবে শোনো-
এই আমি যখন সাবালিকাই হয়নি
তখন আমার দু হাত বেধে দিল,
বলির পাঁঠার মতো বলি হলো সব স্বপ্নের।

পড়াশোনা বন্ধ হলো
শুরু হলো যুদ্ধ
১২ হাত কাপড় পেচিয়ে আমি ছুটতাম
কখনো উঠোনে,কখনো রান্না ঘরে
তবু মন যোগাতে পারিনি কারো।
অবহেলা,অপমান এর জন্য
প্রতিনিয়ত মৃত্যু হতো আমার,
ভালবাসা ছিল কিছু যা একতরফা।

পারমিতা জানোতো –
বিয়েতে বাড়তি মূল্য জোগাতে হয়েছে
আমার বাবাকে,
তবু তাদের লালসা থেমে যায়নি
বরং আরো উগ্র হয়ে ওঠে।
ঝাড়ুপেটা,কিল-লাথি
থাক আর নাইবা শুনলে সেসব।

যার উপর নির্ভর করে বাচতে চেয়েছি
সে আমায় রেখে-
কখনো মরুভূমির দেশে,
কখনো দ্বীপের দেশে ঘুরছে।
অথচ প্রতিনিয়ত আমার মনের সপ্ত সমুদ্র তার অপেক্ষায় শুকিয়ে যাচ্ছে,
সে জেনেও ফিরিয়ে দিয়েছে আমায়।
একদিন জানতে পারলাম
তার নতুন বন্ধু জুটেছিল
প্রশ্ন করতেই,
উত্তরে বলেছিল-
ওরাই নাকি ভীষণ আপন,একাকিত্বের সঙ্গী ।
শুধু যদি এখানেই সব থেমে যেত!
তবে আমি ফিরে আসতাম নাহ।
রোজ ফোনের জন্য অপেক্ষা করতাম,
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসতো –
তবু ফোনে কারো অস্ত্বিত্ব জানান দিত নাহ।
মাঝে মাঝে স্তব্ধ হয়ে যেতাম
একাকিত্ব আর অবহেলার বেড়াজালে
নিজের সত্তাকে ভুলে গিয়েছিলাম।

দেনাপাওনার উপহাস তো ছিলই
নতুন মাত্রায় যোগ হলো আমি বন্ধ্যা,
কেননা বিয়ের ১৬ বছরেও সন্তানের মা হতে পারিনী।
চলতে লাগলো নতুন তোড়জোড়
আমাকে বদলানোর জন্য,
সবটা জেনেও নরকে পড়েছিলাম
কারণ –
একজন ডিভোর্সি বন্ধ্যা নারীর স্থান সভ্য সমাজে নেই।

অতঃপর আমার স্বামী দেশে ফিরলেন
কিছুদিন পর সমাজকে বললাম-
আমি মাতৃত্বের স্বাদ পেতে যাচ্ছি
পরিবার সেদিন ভীষণ খুশি,
সমাজ বললো লক্ষী বৌমা,
অথচ এরাই কিছুদিন আগে আমায় নিয়ে আলোচনা করতে
ক্লান্ত হয়ে যায়নি ।
সবার মনে খুশি
কিন্তু
ভেতরের পাজর ভাঙ্গার শব্দ কেউ উপলব্ধি করেনি।
সিদ্ধান্ত নিলাম
আর নয় সময় হয়ে গেছে সব কিছুর ইতি টানবার।

সেদিন রাতে দাদী চলে গেলেন
আমার প্রসব বেদনা উঠলো
শোকের মাঝেও আলো এলো,
নতুন অতিথিকে পৃথিবীতে আনতে আমি লড়াই করে যাচ্ছি,
এগিয়ে চলছি অজানা গন্তব্যে
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, আমি চলছি অবিরাম
পিছু তাকাইনি আর,
আজ অব্দিও নাহ।
সেদিন সৃষ্টিকর্তাও বড় নিঠুর হয়েছিল
সন্তানকে দেখবার সময় টুকু অব্দি পাইনি,
আমার বাড়িতে দুটো লাশ দাফন হলো,
বড় করুণ ভাবে বরণ হলো নতুন অতিথির।

ভীষণ ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করে
জানো তো-
কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কোন মায়ায় জড়াতে দেয়নি আর।
শুনেছি আমি চলে আসার কয়েকদিন পরেই নাকি
সে আবার বিয়ে করেছে,
নতুন বউ নাকি ভারী মিষ্টি এবং চমৎকার
অর্থের কথা নাই বা বলি-
তুমি সবটা জানোই তো,
বউ নাকি সবার বেশ পছন্দের।

পারমিতা,
কোন এক বিকেলবেলা নতুন অতিথি কে বলো,
তাকে পৃথিবীতে আনতে আমার কতোটা কষ্ট হয়েছে
তাকে বলো সে যেন অমানুষ না হয়
এটাও বলো-
সৌন্দর্য,আভিজাত্য কেন নয়
যেন ভালোবাসতে শিখে।

কালের আবর্তনে স্মৃতিরা সাক্ষী থাকবে,
সাক্ষী থাকবে অপেক্ষারত সময় গুলি
তোমার সময় হলে শুনিয়ে দিও
আমার অব্যক্ত কথা গুলো।

তাজমিন রহমান

শিক্ষার্থী, লোকসাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *