অসামাজিক চলচ্চিত্রের লাগাম টানা জরুরি

অসামাজিক চলচ্চিত্রের লাগাম টানা জরুরি

আবু জাফর: একটা সময় এমন ছিল মানুষ বিনোদনের জন্য তার পরিবারের সকলে মিলে চলচ্চিত্র দেখতো। চলচ্চিত্রগুলো জীবনের কথা বলত, সমাজের কথা বলত, দেশের কথা বলত। চলচ্চিত্র শিল্পের কথা ভেবেই বঙ্গবন্ধু এদেশে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সময়ের আর্বতনে আমরা হয়েছি আধুনিক। পাশ্চাত্য আর হিন্দি চলচ্চিত্র গুলো জায়গা করে নিয়েছে আমাদের বিনোদনে। তার ফলে দিন দিন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে গেছে গোটা শিল্পটি। তার সাথে যুব সমাজ হারিয়েছে তাদের নৈতিকতা। নানাবিধ যৌনাচারে ভরে উঠেছে গোটা সমাজ।

বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম চলচ্চিত্র উৎপাদন কেন্দ্র ঢালিউড হলেও এটি দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। বাংলাদেশীদের চলচ্চিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় ঢাকার নবাব পরিবার। ১৯৫৬ সালে মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্র দিয়ে পথচলা। যাটের দশক থেকেই ভালো চলচ্চিত্র আসতে শুরু করে এবং সত্তরের দশকটা বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এর পর নব্বইয়ের দশকের শুরুর অবধি অনেক ভালোমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও ঊননব্বইয়ের “বেদের মেয়ে জোসনার” ছাড়া আর কোন চলচ্চিত্রই ব্যবসায়িক-সামাজিক সফলতা পায় নি।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য এক হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছেন। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ এবং উন্নয়নের জন্য অল্প সুদে এই তহবিল ঘোষণা করেন। চলচ্চিত্র নির্মাতাগন যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটা উপদেশ মেনে চলে তাহলেই হয়ত হয়ে উঠবে আমাদের ভালো চলচিত্র।

তিনি বলেন “একই সাথে পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা যায় এমন সিনেমা বানানোর জন্য । বাংলা সিনেমার গল্প, অসাধারণ অভিনয় এবং সিনেমা হলের পরিবেশ নিয়ে দর্শকদের অভিযোগ রয়েছে বরাবরই, কিন্তু সিনেমার প্রযোজক যারা রয়েছেন তারা বিষয়গুলো নিয়ে কতটা কাজ করেন তাই দেখার বিষয়। দর্শকদের চাহিদা অনুযায়ী সিনেমার এখন বড় অভাব।

বর্তমান সমাজের বিভিন্ন ইস্যুকে সিনেমাতে তুলে এনে সামাজিক বার্তামূলক চিত্রনাট্য হলে সেটা অনেকেই দেখতে চাইবেন। এখনকার সিনেপ্লেক্সগুলোতে যখন মানুষ যায় তখন বাংলা থেলে ইংরেজি সিনেমাই বেশি দেখতে যায়। কারণ সিনেপ্লেক্সে খুব কম বাংলা সিনেমা দেখানো হয়। আর হলেও অত টাকা খরচ করে বাংলা সিনেমা দেখতে ইচ্ছা করে না। কারণ একটা বাংলা সিনেমা শুরু হলে গল্পের শেষে কী হবে তা আগেই আঁচ করা যায়। গল্পের মধ্যে টান টান কোন উত্তেজনা বা শিল্পীদের অসাধারণ অভিনয় দেখতো পাবো এমন কোন আশাও অনর্থক।

অ্যাকশন মুভি বা বিনোদনমূলক যাই হোক তাতে যদি সামাজিকতা রক্ষা করা হয়। যেকোন একটা ভালো বার্তা যদি পাওয়া যায় তাহলেই তো দর্শকের পয়সা উসুল হবে। তারা ও প্রচুর আসবে। অন্যথায় সিনেমা হলের স্থানে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ ছারা আর কি আশা করা যায়। কিন্তু যে সংখ্যায় সিনেমা হল ভেঙ্গে ফেলা হয় সে সংখ্যায় সিনেমা হল আর তৈরি করা হয় না। ঢাকার সিনেমায় অশ্লীল সংলাপ এবং দৃশ্য নিয়েও প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। নিজ সমাজ-সংস্কৃতির সাথে যায় এমন চলচ্চিত্র যতদিন না করা হবে দিনকে দিন আর তলানিতে যাবে এই শিল্প। তার সাথে বিদেশি অশ্লীল কনটেন্টে ভেসে যাবে আমাদের যুব সমাজ।

আমাদের ভালো কনটেনটেন্টের অভাব হওয়ার কথা নয়। মোগল-ব্রিটিশ-পাকিস্তান বিজয় করা বাংলাদেশীদের বহু ভালো বিষয় আছে। জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়ে আসছে। এ দেশের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ জুড়ে আছে এই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রগুলো। ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, একাত্তরের যীশু, হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড গুলোতে যেমন উঠে এসেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা তেমনি আছে নিজ জন্মভূমিকে ভালোবাসার এক অকৃত্রিম টানের চিত্র। শিশুদের জন্য সিনেমা নির্মাণ হওয়ার সময়ের দাবি। শিশুতোষ চলচ্চিত্র বা এনিমেশন অভাবে আমাদের সেনামনিরা বিদেশি এনিমেশন বা কার্টুন-গেমসে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরো সুস্থ চলচ্চিত্র বিমুখ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রায় ৬০ বছর আগে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের পথচলা শুরু হয়েছিল৷ মাঝে অনেকটা সোনালি সময় পার করেছে এই চলচ্চিত্র৷ কিন্তু পাঁচ যুগ পরে এসে এখন তা অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ করোনাকালে দর্শক সংকট কাটাতে বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে হিন্দি ছবি চালানোর প্রস্তাবও এসেছে৷ সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে এমন পদক্ষেপের বিকল্প নেই বলে নির্মাতাগন মনে করলে তাতে গভীর ভাবে না কোন কাজ করা হবে নিজ সংস্কৃতির জন্য হুমকি।

চলচ্চিত্র প্রদর্শনে বিপর্যয় আসে ১৯৯৯ সাল থেকেই কারন হিসেবে বলা যায় তখন থেকেই অশ্লীলতানির্ভর নিম্নমানের ছবি নির্মাণ শুরু হয়৷ সাধারণ দর্শক তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেরকম ছবি দেখার কথা ভাবতেই পারেনি৷ ভালো নির্মাতার অভাবও চলচ্চিত্রের দুর্দশার মূল কারণ৷ কেননা, এখনো দু-একটি ভালো সিনেমা এলে হল ভর্তি দর্শক দেখা যায়৷ সিনেমা হল বন্ধের হিড়িক একুশ শতকের শুরুতেই শুরু হয়। ঢাকার ‘গুলিস্তান’ ও ‘নাজ’ সিনেমা হল ভেঙে নির্মাণ করা হয় মার্কেট কমপ্লেক্স৷ একইভাবে পুরনো ঢাকার ‘মুন’ ও ‘স্টার’ সিনেমা হল ভেঙেও করা হয়েছে বিশাল মার্কেট৷ ঢাকার ‘এশিয়া’, মধুমতি তে এখন আর জমজমাট আয়োজন হয় না৷ ৷ আশির দশকে ঢাকা শহরে ছিল ৪৪টি সিনেমা হল৷ বর্তমানে কমতে কমতে সংখ্যাটি পঁচিশেরও নীচে নেমে এসেছে৷

চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রযুক্তির ব্যবহারও খুব বেশি বাড়েনি৷ বিগত বছরগুলোতে বিএফডিসির কোনো আধুনিকায়নই হয়নি৷ বিভিন্ন সূত্র বলছে ঢাকার কিছু সিনেমা হলে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে বিদেশি সিনেমা৷ এক টিকেটে ২ ছবি’-র এসব প্রদর্শনীতে মূলত দেখানো হয় পর্নো সিনেমা৷ যা খুবই বিপদজনক কথা।

৯৫ এর পর থেকে আস্তে আস্তে এখন এমন দীনহীন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য যতটানা জনগন দায়ী তার চেয়ে বেশি স্বয়ং ইন্ডাস্ট্রি ও নির্মাতাগন নিজে। ইন্ডাস্ট্রির অব্যবস্থাপনা ও পরিচালকদের অশ্লীল কনটেন্ট গুলোই জনমনে বাংলা সিনেমার প্রতি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করেছে। সরকারি-বেসরকারীভাবে সচেতনতাই পারে আমাদের কে একটি সুস্থ শিল্প উপহার দিতে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *