আন্তর্জাতিক নারী দিবস রচনা
৮ই মার্চ হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সমঅধিকার রক্ষা ও সে সম্পর্কে বিশ্বে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। এছাড়ও কিভাবে এই দিনটি এলা, তথা নারী অধিকার অর্জনের ইতিহাসই কি এ সম্পর্কে জানতে পারবো নিম্নের রচনাটির মাধ্যমে। চলুন, রচনাটি শুরু করি।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
————কাজী নজরুল ইসলাম
ভূমিকা
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হলো নারী। কিন্তু এ নারী সমাজ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাদীক্ষা, কর্মসংস্থান, চাকরির বেতন-ভাতা, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের পেছনে পড়ে আছে। পৃথিবীর প্রতিটি সমাজে নারীরা হচ্ছে নির্যাতিত, নিপীড়িত। তাই নারীরা তাদের প্রতি এ অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তারা বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও সম্মেলনের মাধ্যমে অন্যায়-অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছে। ফলে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। নারী সমাজের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা নারী সমাজের মধ্যে সংহতি ও সম্প্রীতি সুদৃঢ় করার অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘের সহযোগিতায় প্রতি বছর সারা বিশ্বে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক নারী দিবস
১) ১৭৯২ সালের ব্রিটেনে ম্যারি ওয়েলস্টোন ক্র্যাফট নারী ও পুরুষকে এক মানদণ্ডে বিচারের দাবি জানান। কেবলমাত্র শিক্ষা নয়, রাজনৈতিক আইনবিধিতে সংশোধনী এনে নারীর অধস্তন অবস্থা বদলে ফেলার দাবি জানান তিনি। পরবর্তী শতকে তার এ দাবি মূল্যায়ন করা হয়।
২) সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের বিপ্লবী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ, ইংরেজদের গৃহযুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব প্রভৃতি কারণে পুরুষ সমাজ নতুন নতুন অধিকার ভোগ করে। এসময়ই নারীরা মৌলিক অধিকার হিসেবে রাজনৈতিক ও আইনগত অধিকার, সন্তানের ওপর আইনগত দাবি, সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের এবং শিক্ষা ও ভোট দেবার অধিকার লাভ করে।
৩) ১৮৪৮ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস-এর কনভেনশনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাধিকার তথা নারীমুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত মনে করা হয়।
৪) ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের একটি সেলাই কারখানায় শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় নারী শ্রমিকেরা। এর তিন বছর পর ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নারী শ্রমিকদের এক মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে যে ইউনিয়ন গঠিত হয়, তা নারী শ্রমিকের দাবি আদায়ের লক্ষে নেতৃত্ব দেয়। পরবর্তীতে ১৯১০ সালে কোপেনহেগেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে জার্মান নারী নেত্রী ক্লারা সেভকিন প্রস্তাব করেন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার। সম্মেলনে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের নারী প্রতিনিধিরা এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। সেই থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয় আসছে। তবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং প্রসার লাভ করে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে।
নারী আন্দোলনে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা
নারী আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, শুরুতে নারীসমাজের আন্দোলন ছিল মূলত নারী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপ ও আমেরিকার কলকারখানায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পুরুষ শ্রমিকের সাথে তাদের বেতন ভাতার বৈষম্যই সেদিনের সেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। এ কারণেই বলা যায়, নারী শ্রমিকদের শোষণের শুরুটা পাশ্চাত্যেই হয়েছিল। এদিক থেকে নারীসমাজের প্রতি শোষণ-নির্যাতনের যে ঐতিহ্য পাশ্চাত্যে রয়েছে তা প্রাচ্যে ততটা ব্যাপক ছিল না। যা হোক, ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দান করার পর থেকে বিভিন্ন দেশে সভা, সেমিনার ও সম্মেলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে নারীসমাজ। এ ঐক্যের মধ্য দিয়ে, সংহতি ও সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নারীসমাজ একতাবদ্ধ হয়। এ সম্প্রীতি সুদৃঢ় করার লক্ষেই সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
নারী দিবসে বাংলাদেশের ভূমিকা
নারী মুক্তি, নারীর স্বাধীনতা, নারীদের সমান আধিকার, আত্মমর্যাদার লড়াইকে সামনে এগিয়ে নেবার শপখ নিয়েই সারা বিশ্বের নারী পুরুষ এ দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। তবে আমাদের দেশের নারীরাই এর জন্য সংগ্রাম করছে এবং দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করছে। পুরুষরা এখনো এ দিবসটিকে ততটা নিজেদের বলে মনে করতে পারছে না। নারীদের মুক্তির অর্থ হচ্ছে সমাজের মুক্তি। সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে নারীসমাজের মূল্যায়ন, তাদের উন্নতি। কিন্তু বিষয়টি মনের দিক থেকে মেনে নেবার আবস্থা আমাদের সমাজে এখনো গড়ে ওঠে নি। তাই ৮ মার্চ পালনের প্রস্তুতি নারীসমাজকেই নিতে হচ্ছে। প্রতিবছর সম্মিলিত নারীসমাজ এ দিবসটি ঘটা করে পালন করছে। এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এ দিবসটি পালন করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারী দিবসের গুরুত্ব অত্যধিক। যেমন- ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক বাধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রজনন প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রতিবন্ধকতা জাতীয় অগ্রগতিকে বিলম্বিত করছে। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
নারী দিবসে জাতিসংঘের ভূমিকা
নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘ ৮ মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। নারীর মৌলিক অধিকারগুলোকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের ব্যাপারেও জাতিসংঘ প্রচেষ্টা চালায়। এ লক্ষে জাতিসংঘ ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সালকে ‘নারী দশক’ হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় মেক্সিকো, কোপেনহেগেন, নাইরোবি এবং বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হয় চারটি বিশ্ব নারী সম্মেলন।
নারী দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
নারীদের কাজের স্বীকৃতি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনায় নারীর ভূমিকা, নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা, উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বীকৃতি, নারীপুরুষের সমতা নিশ্চিতকরণ, সারা বিশ্বে নারী নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধ করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রজনন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীর প্রতিবন্ধকতা দূর করাসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ নারী দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বিশ্ব নারী সম্মেলন: ১৯৯৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ শতকের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন চীনের রাজধানী বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রায় ৫ হাজার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। বেইজিং নারী সম্মেলনের শ্লোগান ছিল ‘নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন’। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানির বোর্ডরুম পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লড়াইয়ের দৃঢ় অঙ্গীকার ও ‘নারীরা জাগছে’ শীর্ষক ঘোষণার মধ্য দিয়ে সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে জাতিসংঘে নারীর মর্যাদা সংক্রান্ত কমিশনের প্রধান ফিলিপাইনের প্যাট্রিসিয়া লিকিউযানান বলেন, “নারীরা মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা ভোগ করবে এ আশঙ্কা থেকে প্রজনন, স্বাস্থ্য, যৌনতার মতো অনেকগুলো বিষয় বিতর্কিত হয়েছে। যার মাধ্যমে রক্ষণশীল মানসিকতার লক্ষণ দেখা গেছে।” বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জেমস আলফেনশন তাঁর সমাপ্তি ভাষণে নারীদের শিক্ষার জন্য বছরে ৯০ কোটি ডলার অনুদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, এর ফলে বিশ্ব নেতৃত্বে নারীদের ভূমিকা শক্তিশালী হবে।”
বেইজিং সম্মেলনের বিতর্কিত বিষয়
চীনের রাজধানী বেইজিং-এ নারী সম্মেলনের ১৫০ পৃষ্ঠার দলিলের যে বিষয়গুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি তর্ক- বিতর্ক হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে যৌন স্বাধীনতা ও নারী নির্যাতন হ্রাস সংক্রান্ত বিষয়গুলো। আলোচকদের মতে, এ বিষয়গুলো নারী পাচার, মেয়ে শিশুদের পুষ্টিহীনতা ও যৌনতায় বাধ্য করার মতো নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কিন্তু ভ্যাটিকান ও ইসলামি দেশগুলোর প্রবল বাধার মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ উত্থাপিত সমকামিতার অধিকার সংক্রান্ত অংশটি চূড়ান্ত দলিল থেকে বাদ পড়ে।
উপসংহার
আজকের নারী আন্দোলন আন্তর্জাতিক রূপলাভ করেছে- যার পেছনে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চের অবদানকে প্রধান হিসেবে ধরা হয়। শোষিত ও শ্রমজীবী নারী ন্যায্য মজুরি, অধিকার ও মর্যাদার দাবিতে কতটা সংঘবদ্ধ এবং সোচ্চার হতে পারে, দীর্ঘদিনের শোষণ কতটা বিক্ষুব্ধ হতে পারে, তার প্রমাণ নারীরা রেখেছিল ৮ মার্চে রক্ত ঝরিয়ে। যার ফলশ্রুতিতে ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে গোটা বিশ্বে মর্যাদার সাথে পালন করা হয়ে থাকে।