আব্বার ঢাকা ভ্রমণ | নাহিদ হাসান নিবিড়

আব্বার ঢাকা ভ্রমণ | নাহিদ হাসান নিবিড়

আব্বা ঢাকায় আসছে। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর এটাই আব্বার প্রথম আগমন। আমার মেসের জীবন, অগোছালো ঘর, প্যান্ট-শার্ট, গেঞ্জি ঘিঞ্জি লেগে একটার উপর আরেকটা পড়ে আছে। বিছানার নিচে সিগারেটের এস্ট্রে থাকলেও পুরো ঘরের মেঝেতে সিগারেটের ছড়াছড়ি। আব্বার আসার কথা শুনে ধুয়ে মুছে সব পরিস্কার করে রেখেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মেসে উঠবার পর আম্মার হাতের রান্নার জায়গায় বুয়ার হাতের রান্না প্রথম প্রথম আমার মুখে রচতো না। কয়দিন হোটেলে খেয়ে গোটা মাসের খরচের টাকা বিসর্জন দিয়ে বুয়ার হাতের রান্না খেতে শিখেছিলাম। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেছি কিন্তু আব্বার পক্ষে বুয়ার হাতের রান্না খাওয়া সম্ভব না।
আব্বা আমি দুজন মিলে হোটেলে গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি বিল দিতে গিয়েছিলাম, আব্বা বলল, ‘টাকা কি বেশি হইছে?’
আমি চুপ মেরে গিয়েছিলাম। এর আগেও বহুবার আব্বা ঢাকায় এসেছেন, তখনও তিনিই বিল দিয়েছেন, এইবারও তিনিই দিলেন।

আব্বা অফিসের কাজে পল্লীবিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে এসেছেন। আসার সময় আমাকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন। আব্বা কাজ করছিলেন আমি তাঁর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম, এই মানুষটি আমার আব্বা! কত সহজ-সরল কোমল দুটি চোখ তাঁর! আব্বার গলার স্বর, ঠোঁট দুটোর নড়া-চড়া থেকে শুরু করে সেলাই করা বাটার জুতা সবকিছুই আমাকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করছে। আমি কেবল মুগ্ধ নয়নে আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি। কখনো বলা হয়নি, আব্বা আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি, আব্বাও কখনো বলে না, তবে ইন্টারমেডিয়েট শেষ করে যখন ঢাকায় চলে আসলাম সেবার মেসে তুলে দিয়ে চলে যাবার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলেন। হয়ত বাড়ি ফিরেও কেঁদেছেন, এরপর অসংখ্য দিন আমাকে মনে পড়তেই কেঁদেছেন।

আব্বার কাজ শেষ, মাজার রোড থেকে গাড়িতে উঠবেন, এর আগে নিউমার্কেট থেকে কিছু কেনাকাটা করবেন। আমি বললাম, ‘আমি সাথে যাই, পৌঁছে দিয়ে আসি?’

আব্বা বললেন, ‘না লাগবে না, তুই বরং মেসে ফিরে যা, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, সকালে আবার ক্লাসে যাবি। আমার সাথে যেতে হবে না।’

আব্বার নিষেধ সত্ত্বেও পেছন পেছন গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। আব্বা আর কিছু বললেন না।

কতদিন পর আব্বার সান্নিধ্য পেলাম! আব্বার হাত ধরে রিক্সায় টেনে তুলেছি, বাহু ধরে রাস্তা পার করেছি, একসাথে অনেকটা পথ বাপ-বেটা মিলে হেঁটেছি। এমন দিন আবার কবে আসবে জানি না।
গাড়ি থেকে নেমে নিউমার্কেট গিয়ে আব্বা আম্মার জন্য শাড়ী, ছোট ভাই-বোনদের জন্য জামা-কাপড় কিনতে শুরু করলেন, আমাকেও একটা শার্ট কিনে দিলেন। আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছিল, ‘আব্বা আপনার জন্যে কিছু নিবেন না?’ কিন্তু মুখ থেকে বের হচ্ছিল না।

কেনাকাটার শেষ পর্যায়ে বলেই ফেললাম, ‘আব্বা আপনার জন্যে কিছু নিবেন না?’
আব্বা অনাগ্রহে বললেন, ‘আমি আবার কি নিবো? আমারতো সবই আছে।’
নিউমার্কেট থেকে কেনাকাটা শেষ করে আব্বার সাথে মাজার রোডে গাড়ির কাউন্টারে গেলাম। গাড়ির টিকিট কেটে আব্বার পাশে বসে আছি। আব্বা জানতে চাইল, খরচের টাকা আছে কিনা।
আমি বললাম, ‘আছে।’

এরপরও আব্বা কিছু টাকা পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। ভাবিনি এত টাকা দিবেন, আব্বা চলে যাবার পর দেখেছি।
আব্বা কাউন্টার থেকে বার বার তাড়া দিচ্ছিলেন মেসে ফেরার, মেস এখান থেকে অনেক দূরের পথ, রাত অনেক হল, তাড়াতাড়ি চলে যা, রাতের শহর ভাল না। আরও কত কত কথা, আমি কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলাম। ইচ্ছা হচ্ছিল, আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদি, কিন্তু পারলাম না।

গাড়ি আসার পর, আব্বা কাউন্টার থেকে বের হলেন। সুপারভাইজার যাত্রীদের দ্রুত গাড়িতে উঠার তাড়া দিচ্ছিল, আব্বা গাড়ির দরজার দিকে পা বাড়ালেন। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল আমিও উঠে যাই, পুরোটা রাস্তা আব্বার বুকে মাথা গুজে রাখি। আমি ডাক দিলাম, ‘আব্বা!’
আব্বা থামলেন। আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আব্বার পা ছুঁয়ে সালাম করতেই আব্বা আমার মাথায় হাত রাখলেন। কি মমতা! কত স্নেহ-ভালোবাসা যেন এই স্পর্শে লুকিয়ে রয়েছে! এই স্পর্শটুকুর জন্যেই এতটা পথ এসেছি।

আব্বার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আমিও হাঁটতে শুরু করলাম। চোখ দুটো থেকে বৃষ্টির মতন টপটপ করে জল ঝরতে শুরু করেছে। টেকনিক্যাল মোড় থেকে টিকিট কেটে গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ির ভেতরটা মোটামুটি ফাঁকা৷ পেছনের দিকে জানালার পাশের একটা সিটে গিয়ে বসলাম। জানালা দিয়ে বাতাসের ঝাপটা এসে চোখে লাগছে। দ্রুত আব্বার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি।

কিছুদিন থেকে ভীষণ বিষন্নতায় ভুগছিলাম। আব্বা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করার পর এক মুহূর্তেই সকল বিষন্নতা কেটে গেছে। এটা সেই বিশ্বস্ত হাতের স্পর্শ, যেই হাত সেই জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি আমাকে আগলে রেখেছে ঠিক ছায়ার মতন।

ইচ্ছা করছে গাড়ি থেকে নেমে ছুটে আব্বার কাছে চলে যাই। সেই ছোটবেলার অবুঝ বাচ্চাটির মতো একলাফে আব্বার কোলে উঠে যাই, আমাকে রেখে কোথাও যেতে চাইলে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেই।

সময়ের কাছে আমাদের জীবন-সম্পর্কের কত সীমাবদ্ধতা! ছেলেবেলায় যার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি, পা তুলে দিয়েছি গায়ে, জেদ চেপে না খেয়ে থাকলে যে রাগ ভাঙ্গিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে, তাকে এতো কাছে পেয়েও বলতে পারলাম না,

‘ভালোবাসি, আব্বা আপনাকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি।’
রাস্তায় তেমন জ্যামজট নেই। গাড়ি দ্রুত চলছে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আব্বা এসে আমার পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকলেন, ‘খোকা!’

আমার খুব অভিমান হল। আমি কোন উত্তর দিলাম না।আব্বা আমার গাল টেনে দিয়ে বললেন, ‘অভিমান করেছিস খোকা?’
আমি অভিমানঝরা গলায় বললাম, ‘হু।’
– কেনরে?
– তুমি এত ভাল কেন? আমি তোমাক অনেক অনেক ভালোবাসি।
– আমি জানি খোকা।
– না জানো না তুমি, জানলে কখনো বুকে টেনে নাও না কেন?
– এই জন্যে অভিমান করে আছিস! আয় বুকে আয়, সারারাত তোকে আজ এমনি করে সেই ছোটবেলার মতন বুকে জড়িয়ে ধরে রাখব।
– ছাড়বে না কিন্তু!
– না ছাড়ব না।

কন্ডাক্টরের ডাকে চোখের পাতা মেলে তাকালাম। গাড়ি থেকে নেমে মেসের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ফোন ভাইব্রেট করছে, পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলাম, আব্বা ফোন করেছে।
আমি ফোন ধরলাম। আব্বা বললেন, ‘মেসে পৌঁছাসনাই এখনো?’
– এই তো চলে আসছি।
– রাস্তায় কোন সমস্যা হয় নাই তো?
– নাহ।
– আচ্ছা, তাহলে মেসে গিয়ে কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
– আচ্ছা। আপনি কতদূর গেলেন?
– এই তো যমুনার কাছাকাছি। আচ্ছা রাখি তাইলে।
আব্বা ফোন রেখে দিলেন। আমার আর বলা হল না,
‘ভালোবাসি, সাবধানে যেয়ো বাবা। ভাল থেকো।’
“রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সগীরা।”

নাহিদ হাসান নিবিড়
লেখক,
উপন্যাস: ‘দিগন্তগামী ফিনিক্স’

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *