আমাদের দয়া করে সেশনজটের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি দিন

আমাদের দয়া করে সেশনজটের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি দিন

নয়ন দেব নাথ


আমারা কি জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি? বলছি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর থেকে। আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন ছাত্র। পড়াশোনার নিম্নস্তরের ধাপসমূহ অতিক্রম করে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে দ্বার হয়েছে।

বিগত শিক্ষা জীবনে কখনো কোনো সময় কোনো শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হয় নি। তাই শিক্ষা জীবন থেকে একটি বছর নষ্ট হওয়ার বা একটি বছর পিছিয়ে পড়ার বা নিজের সহপাঠীদের আমাকে পিছনে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার, যে কি কষ্ট, কতটা বেদনার, কতটা অপমান জনক সেই বোধটা এর আগে কখনো হয় নি। কিন্তু আজ যখন উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলাম, আজ সেই ব্যথা, সেই কষ্ট, সেই অপমান যেনো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

কেনো আমি আজ সেই বেদনা অনুভব করছি? কেনো আজ সেই অপমান আমাকে লজ্জা দিচ্ছে? তাহলে কি আমি কোনো পরীক্ষায় উপস্থিত থাকতে পারি নি?
না __
তাহলে কি আমি কোনো পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে পারি নি?
না__
তাহলে কি আমি কোনো কারণে রিয়েক্ট খেয়েছি ?
না __
না, না, না___ এতো যদি না উত্তর আসবে তাহলে আমার এই কষ্ট, এই অপমান বোধের কারণ টা কি? কেনো আমার শিক্ষাজীবন থেকে একটি বা দুটি বছর ঝরে যাচ্ছে?

আমি তো অকৃতকার্য ছাত্র না! আমি তো পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েই এখানে এসেছি। আমি তো একাডেমিক সব পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার সক্ষমতা রাখি। তাহলে কেনো অযথা অকারণে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থেকে সুন্দর একটি বছর ঝরে যাচ্ছে? আমাদের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন থেকে মূল্যবান একটি বছর ঝরে যাওয়ার বড় একটি কারণ হলো সেশন-জট ।

সেশনজটের মত একটি জঘন্য সর্বনাশী পরিস্থিতি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জীবনে নির্মম আঘাত হানছে, শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের অবহেলায়। শুধুমাত্র কতিপয় শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্বের অবহেলার জন্য সেশনজটের মত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। সেশনজটের মত জঘন্য পরিস্থিতিতে কেনো শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে? এটা কতটা ভয়ানক, কতটা লজ্জাকর এগুলো কি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা যেসব ডিপার্টমেন্টে সেশনজটের মত জঘন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেইসব ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক মহোদয়েরা কি বুঝতে পারচ্ছেন বা অনুধাবন করার চেষ্টা করছেন?

আপনাদের সাথে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক শুধু মাসিক বেতন বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধার সাথে শিক্ষার্থীদের কল্যাণের বা ভবিষ্যৎ এর সাথে নয়? আমরা দেখি একই সময়ে যখন সহপাঠিদের সাথে ন্যাশনাল কলেজ, পাব্লিক বিশ্ববিদ্যাল বা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই তখন দূর্ভাগ্যবশত কারণে দেখি আমার কোনো সহপাঠী আমার থেকে একধাপ এগিয়ে গেল। আমার তাঁর সাথে সমগতিতে চলার কথা, কিন্তু কতিপয় মানুষের দায়িত্বের অবহেলার কারণে আমাকে আমার সহপাঠীর তুলনায় একটি বছর পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে।

এটা কী বেদনাদায়ক নয়? যখন দেখছি আমার জুনিয়র বা যারা আমার পরের সেশনে ভর্তি হয়েছে অথচ আমার আগেই তাঁর গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ হচ্ছে। এটা কি লজ্জাকর নয়? যখন একটি দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক সন্তানের পড়াশোনার ব্যায়ভার বহন করতে করতে বিরক্ত হয়ে বলছে, আর কতদিন লাগবে তোমার গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ হতে? তোমার জুনিয়র গুলো গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করে চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরেছে আর তোমার গ্রাজুয়েশন শেষ হচ্ছে না! তখন কী তাদের বিরক্তিমাখা শশব্দগুলো বুকে আঘাত করছে না?

যখন দেখি পড়াশোনা চুকাতেই সরকারি চাকুরির বয়সসীমা শেষের কোঠায় যেতে শুরু করেছে তখন কী হতাশা আমায় তারা করছে না? তাহলে কেনো দায়িত্বে অবহেলা করে মেধাবীদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন? একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট যথা সময়ে এগিয়ে যেতে পারছে, তাহলে আপনারা কেনো পারছেন না? খোঁজ নিয়ে দেখেন তো আপনারা উনাদের থেকে বেশি ক্লাস নিয়ে থাকেন নাকি? উনাদের তুলনায় বেশি সময় দিয়ে থাকেন নাকি?

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সেশন ২০১৭-১৮, বর্তমানে আমি একজন ৩য় বর্ষের ছাত্র হওয়ার কথা, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার সিস্টেম এবং আমি এবার ৩য় সেমিস্টার ফাইনাল দিয়েছি মাত্র, বর্ষের দিক থেকে ২য় বর্ষের প্রথমার্ধ, কিন্তু পরিক্ষা দেওয়ার ৭ মাস পেরিয়ে গেলো ফলাফল এখনো পেলাম না। ন্যাশনালে পড়া বা আমাদের ভার্সিটিতেই অন্য কিছু ডিপার্টমেন্টের সহপাঠীদের করনা কালীন এই সময়েও বছর শেষে ৪র্থ বর্ষে পদার্পণ করার সম্ভাবনা বা আশা রাখে। অথচ আমারা ২য় বর্ষ শেষ করতে পারবো কিনা সন্ধেহে আছি!

দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি যে অনেকেরি অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে, পরীক্ষা হচ্ছে। আর আমার মনে হয় আমারা কোনো এক আদিম যুগে পড়ে আছি যে আমাদের মাঝে এখনো আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগে নি যে, অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা তো দূরে থাক ৭ মাস আগে সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়া পরীক্ষার ফলাফল পর্যন্ত পাচ্ছি না।

কই অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ডিপার্টমেন্ট তো সরকারের বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাধ্যতামূলক আদেশের অপেক্ষায় বসে নেই উনারাও তো অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন, পরীক্ষা নিচ্ছেন উনাদের শিক্ষাক্রম চালু রাখার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে আপনারা কেনো চাচ্ছেন না মেধাবী শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট না করে তাঁদের সুন্দর একটি আগামীর দিকে এগিতে দিতে।

একটি পরিবারের অভিভাবক সংসারের সংকট কালে সর্বোচ্চ চেষ্টা ও পরিশ্রম করে সমস্যা সমাধান করে। দয়া করে আপনারাও নিজেদের ডিপার্টমেন্টকে নিজেদের পরিবার ভাবুন, শিক্ষার্থীদের নিজেদের সন্তান মনে করে এই সমস্যার সমাধান করুন। আপনারা চাইলেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। শিক্ষার্থীরা তো সবসময় আপনাদের পাশে থাকে, আপনারাও শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার চেষ্টা করুন না একটু।

শ্রদ্ধেয় সকল শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের নিকট বিনীত অনুরোধ আমাদের দয়া করে সেশনজটের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি দিন।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *