ইউটিউবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি গোল্ডেন প্লে-বাটন পেলো কুঁড়েঘর

ইউটিউবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি গোল্ডেন প্লে-বাটন পেলো কুঁড়েঘর

বিনোদন টুডে

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড কুঁড়েঘর ইউটিউবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি গোল্ডেন প্লে-বাটন পেয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন কুঁড়েঘর ব্যান্ডের প্রধান ভোকালিস্ট তাসরিফ খান।

ফেসবুক পোস্টে বলেন, ৫ই জানুয়ারি ২০১৭ আমাদের ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয় এবং আজ ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ আমাদের হাতে । পেছনে ফিরে তাকালে ছবির মত সব চোখের সামনে ভাসতে থাকে। ইউটিউবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি গোল্ডেন প্লে-বাটন। অনেকটা শূন্য থেকে সামান্য কিছু হবার গল্প ।

৮ আগস্ট ২০১৬ তে যেদিন নিজের ব্যাক্তিগত ইউটিউব চ্যানেল ক্রিয়েট করেছিলাম, সেদিন ফেইসবুক ফ্রেন্ডলিস্টের চেনা অচেনা প্রায় ১৬০০ মানুষকে অনুরোধ করলে, ২৪ জন মানুষ চ্যানেলটা সাবস্ক্রাইব করেছিল। আমি তো সে কি খুশি! সেদিন থেকেই একা একা গান গেয়ে আপলোড করা শুরু করি আর স্বপ্ন দেখতে থাকি, একদিন আমারও একটা ব্যান্ড হবে, মানুষ আমার গান শুনবে, স্টেজে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গান গাইবো, আরও কতো কি!

কিছুদিনের মাঝেই এলাকার পরিচিত কিছু ছোট ভাই আর বন্ধুকে ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়েই বসি, আমরা একটা ব্যান্ড করবো যার নাম ঠিক হয় “কুঁড়েঘর” ।

তাসরিফ আরও বলেন, কলেজের দেয়ালের পাশে কিংবা পুকুর পাড়ে বসে গান করা কয়েক জন উটকো ছেলের (সমাজের অনেকের চোখেই) প্রথম কন্টেন্ট ইউটিউবে আপলোড হয় ৩ ডিসেম্বার ২০১৬ । ইউটিউবে কিভাবে আপলোড করতে হয় এটা ছাড়া আর কোন জ্ঞান না থাকা আমরা, প্রথম দিন শেষে দেখি গান এর ভিউ ৪০০!! এ তো মহা অবাক করা বেপার!! ৪০০ মানে তো অনেক, পুরো একটা কলেজ মাঠই তো ভরে যায় ৪০০ মানুষ হলে ! এতো মানুষ আমাদের গান দেখলো ?!! তার পর দিন আরো, তার পর আরো!!… কমেন্টবক্সে মানুষের প্রশংসায় ভেসে যেতে থাকলাম আমরা ।।

কিছুদিন পুরই পুরো ব্যান্ড ঢাকায় চলে আসি এবং আমার (Tasrif Khan) বাসায় থেকেই আমি,শুভ,সাব্বির, শ্রাবন সহ আরও কয়েক জন মিলে শুরু করলাম কাজ! আমার ছোট ভাই Tanjeeb Khan (বর্তমানে ব্যান্ড এর ফাউন্ডার,গিটারিস্ট এবং ডিজিটাল এক্সপার্ট) বসে বসে শেখা শুরু করলো ইউটিউব আর ভিডিও এডিটিং রিলেটেড পড়াশোনা! আমাদের ব্যান্ড এর রুটিন ছিল সারাদিন ছাঁদে বসে কন্টেন্ট তৈরী, এডিটিং, আর রাতের মাঝেই ইউটিউবে আপলোড। কি যে ছিলো সেই দিন গুলো!!!

শুরুতে ফোন দিয়ে,তারপর সাউন্ড বোম এবং এরপর শিখলাম সাউন্ড রেকর্ডার দিয়ে গানের রেকর্ড করা ।পুরো গানের রেকর্ড টা একবারে এক টেইকে করা লাগতো এবং সেক্ষেত্রে দেখা যেতো একটা গান রেকর্ড করার সময় শেষের লাইনে যেয়েও যদি কারও একটু খানি ভুল হইয় তাহলে পুরো গানটাই আবার শুরু থেকে রেকর্ড করা লাগতো ।

কোন কোন রেকর্ড করতে আমাদের ১০০ বারেরও বেশি চেষ্টা করতে হয়েছে । ঘরে রেকর্ডে বসলে আমাদের ৩ থেকে ৫ ঘন্টা লেগে যেতো আর পুরো সময়টাই আমরা ফ্যান বন্ধ করে দরজা জানালা লাগিয়ে রেকর্ড করতাম যেন বাহিরের আওয়াজ না আসে আর ঘামতে ঘামতে সবাই একদম গোসল হয়ে যেতাম । একবার হয়ে গেলে সে কি যে আনন্দ তা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়!

ভিডিও তে ঠিকমত ট্যাগিং করা কিংবা থাম্বনেইল এড করাটা শিখতে প্রায় বছরের বেশি সময় লেগেছে আমাদের । গত তিন বছর, প্রতিটা দিনই ছিলো কিছু না কিছু শেখার দিন!!

প্রথম কন্সার্ট এর কল! কি যে ভাল লাগা, আর কত যে চ্যালেঞ্জ…! আর দেখতে দেখতে এখন তো ১২০ এর বেশি কন্সার্ট হয়ে গেছে!! প্রথম বার দেশের বাইরে যাওয়া… তারা হুড়োয় পাসপোর্ট করাও একটা বিশাল যুদ্ধ… পাসপোর্টের জটিলতায় তো প্রথমবার ভারতের কনসার্টের তারিখই পেছাতে হয়েছিল । আমাদের একেক টা যুদ্ধ একেক টা বই এর প্রথম অধ্যায় এর মত!

মনে আছে, যখন আমাদের কনসার্ট ওভাবে শুরু হয়নি কিন্তু ইউটিউবে প্রচুর সারা পাচ্ছি, তখন থেকেই আমাদের ব্যান্ড মিটিং গুলোতে বার বার ই কথা হতো যে সরাসরি কিভাবে মানুষের আরো কাছে যাওয়া যায়? কিভাবে কনসার্টের এর কল ছাড়াও কনসার্ট করা যায়!! সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা নতুন একটা কাজ করব, একটা ভিন্নধর্মী ইভেন্ট! নাম হবে “কুঁড়েঘর আড্ডা”।

ব্যাপার টা তেমন কিছুই নয়, ফেসবুকে ইভেন্ট/স্টেটাস কিংবা ফোনে যোগাযোগ করে কোন একটা নির্দিষ্ট যায়গায় গিয়ে অপরিচিত মানুষ জনের সাথে আড্ডা আর গান গাইব!! বিশ্বাস করবেন না, কতো যে অসাধারন ছিল ব্যাপার গুলো!! আমরা ধানমন্ডি লেক,রবীন্দ্র সরবর, সংসদ ভবনের এর সামনে কিংবা কোন একটা জেলার মাঠে চলে গেছি পুরো ব্যান্ড এবং শুরু করেছি আড্ডা…অনেকেই শুরু তে হেসেছে, কিন্তু দিন শেষে যখন ঘরে ফিরেছি, ভালো লাগা আর মানুষ সম্পর্কে শিখার খাতা টা আরো পূর্ণ হয়েছে!!

অসংখ্য আড্ডা করেছি আমরা!! মাত্র ২০ হাজার টাকায়ও কন্সার্ট করেছি অনেক! আমাদের হিসেব ছিলো সহজ, তখন আমাদের হাতে অনেক সময়, তাই সময়ের দাম কম। মানুষ যা দিতে পারবে তাতেই খুশী আর যখন ব্যাস্ততা বাড়বে, সময় কমবে, তখন সময় এর দামও নিশ্চই বাড়বে । শারীরিক কষ্ট হয়েছে অনেক, সারাদিন প্র্যাক্টিস করে চা বিস্কুট খেতে হয়েছে কারন ৭ জন এর হোটেলে খাবার পয়সা ছিলো না সেদিন, কিন্তু কোনদিনও মন খারাপ লাগেনি বরং কষ্ট গুলোকে আসলেই কষ্ট মনে হয়নি আমাদের!!

এরই মাঝে অনেকেই ব্যান্ড ছেড়েছে, অনেকেই এসেছে!! আসলে গল্প শুরু করলে তো শেষ হবার নয়!!

একটা সময় আমাদের মনে হয় মানুষ হিসেবে আরো ভাল হওয়ার জন্য আর কি কি করা যায়?! সিদ্ধান্ত হয় মানুষের কষ্ট গুলো কাছ থেকে দেখব। আমরা সময় কাটাই কিছু হাসপাতালে, রাত কাটাই রেল স্টেশনে আর এরই অংশ হিসেবে আমাদের ব্যান্ড এর তৃতীয় জন্মদিন উপলক্ষে যাই বৃদ্ধাশ্রমে!! এ সবই আমাদের অবর্ণনীয় শেখার উৎস আর নিজেদের আবিস্কার করার উপলক্ষ ছিল!!

আমাদের যেমন শেখার গল্প ছিল তেমনি মন ভাঙ্গার গল্পও ছিল…। ব্যান্ডের শুরুতে যখন আমরা ঢকায় আসি, আমার ভার্সিটির এক বন্ধুর মাধ্যমে একটা পারফর্মেন্সের ডাক পাই ধানমন্ডির এক নামিদামি রেস্ট্রুরেন্টে । আমরা ত সেদিন অনেক এক্সাইটেড! টুক টাক শপিংও করি, কনসার্ট বলে কথা!! সারাদিন গানগুলো বারবার প্রেক্টিস করে সন্ধায় চলে যাই পারফর্ম করার জন্যে । ২ ঘন্টা বসে থাকি আমাদের ডাক আসলে আমরা স্টেইজে উঠব । হঠাৎ একজন অর্গানাইজার এসে জনায় যে তাঁদের হাতে তেমন সময় নেই, আমাদের পারফর্মেন্স টা হবে না। আমরা কিছুখন নিজেদের মুখ চাওয়া করে চুপচাপ ধানমন্ডি লেকে চলে যাই ।রাতের অন্ধকারে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম আমি,শুভ আর শ্রাবন । আমি ওদের চখের দিকে তাকাবার সাহস পাইনি সেদিন রাতে ।

আরেক রাতের কথা মনে পড়ছে…তখন আমাদের দুই তিনটা গান কেবল রিলিজ হলো। একটা শীতের রাতে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আমরা শীতার্দদের জন্যে ফান্ড সংগ্রহ করতে করতে ধানমন্ডি লেকে যাই । ওখানে যেয়ে দেখি বেশ কিছু মিউজিশিয়ান খালি গলায় গান বাজনা করছে । আমরাও যেয়ে অনুমতি নিয়ে বসে পরি উনাদের সাথে আর গলা মেলাতে থাকি একের পর এক গানে ।

এরমাঝে উনারা একটু গানের বিরতি নিলে আমি আর শুভ সাহস করে আমাদের “আমি মানে তুমি” গানটা গাই আর মুহ্নুর্তেই আশপাশ থেকে লোকজন এসে জড়ো হয়ে যায় । এক পর্যায়ে আমার গীটারের তারটা ছিড়ে গেলে আমি উনাদের কাছে অনুরোধ করি যে “ভাইয়া এই গীটারটা ত আপনারা এখন বাজাচ্ছেন না, আমি একটু নিয়ে বাজাই??

“ এটা বলে আমি হাত বাড়ালে প্রতুত্তরে এক ভাইয়া বলে “ না গীটারে হাত দিও না, এইটা দামি গিটার । আমার গীটার যারে তারে দেই না ভাই “ । সত্যি বলতে সেই রাতে শুভ কেদেছিল ! সেদিন সবার সামনে অপমান হয়েও আমি কাদিনাই, দাতেদাত চেপে ওয়াদা করেছিলাম সবকিছুর জবাব কাজের মাধ্যমেই দেব একদিন । এরকম বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংখ্যাও কিন্তু কম নয়,

কষ্ট পেয়েছি, ভেঙ্গে পড়েছি বারবার, আবার উঠে দাঁড়িয়েছি । প্রতিটা আঘাতই আমাদের আরও শক্তিশালি করেছে । থাক সেসব কথা…

এরকম ভাল মন্দ মিলেই চলতে থাকে কুঁড়েঘর এর জার্নি ! একে একে গান আসে এবং আরোও বৃহৎ ভাবে সারা পেতে থাকি আমরা! বাড়তে থাকে কন্সার্ট আর আমাদের জীবনের গতি! সবার দোয়ায় এবং আমাদের অক্লান্ত চেষ্টায় ছোট্ট কুঁড়েঘর ইতিমধ্যই আজ মানুষের ভালবাসায় পুর্ণ আর সেই পূর্ণতায় যোগ হলো বাংলাদেশের একমাত্র ব্যান্ড এর ইউটিঊব চ্যানেল হিসেবে ইউটিউব এর পক্ষ থেকে পাওয়া স্বীকৃতি, গোল্ডেন প্লে বাটন!

না, ইউটিউব আমাদের স্বীকৃতি দেয়া মানেই যে আমরা ভাল ব্যান্ড তা কিন্তু মোটেই না, আমাদের ভাল কিংবা খারাপের বিচারক আপনারা, যারা আমদের শুনেন, শুনছেন কিংবা ভবিষ্যতে শুনবেন।

ব্যান্ড হিসেবে আমরা একেবারেই শিশু! বড় স্টেজে নিজদের ব্যান্ড বলার আগে এখনো ডানে বায়ে তাকাই, তবে দোয়া করবেন … একদিন নিশ্চয়ই হতে পারব!

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *