উচ্চ শিক্ষার অবহেলার ৫০ বছর: স্বায়ত্তশাসিত নাকি সরকারি? পর্ব-১

উচ্চ শিক্ষার অবহেলার ৫০ বছর: স্বায়ত্তশাসিত নাকি সরকারি? পর্ব-১

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


গত ২০ অক্টোবর ২০১৮ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত প্রথমবারের মত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষকগণ ভেবেছিল, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁদের প্রয়োজনের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো বলার সুযোগ পাবেন।

শিক্ষকদের চাহিদা ও দাবি-দাওয়ার বিষয়ে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ কোন লিখিত আবেদন না করায় বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে উল্লেখ করেন এবং শিক্ষকবৃন্দ সম্মেলন কক্ষে বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তবে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে রক্ষার্থে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্মেলন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি সম্মেলনের কোন বিকল্প নেই।

বর্তমানে সারা দেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় সোয়া আট লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। আর ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন আরও পৌনে চার লাখ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে আছেন আরও বিপুল শিক্ষার্থী।

করোনাকালীন সময়ে দেখেছি বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনা বিষয়ে গবেষনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আর আমাদের দেশের ২/৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পিসিআর মেশিন দিয়ে টেস্ট এবং অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা নিচ্ছে যা বাহাবা পাবার যোগ্য।

সাম্প্রতিককালে, করোনাকালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস চালুর লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি) একটি জরিপে দেখা যায়, দেশের উচ্চশিক্ষায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৬২ শতাংশের স্মার্টফোন রয়েছে। যদিও অনেকের ইন্টারনেট খরচসহ নানা সমস্যা রয়েছে।

করোনার কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) উচ্চশিক্ষায় অনলাইনে শিক্ষার জন্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্টারনেট খরচ দিতে চায়। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, অনলাইন ক্লাস না করার পেছনে বাধা- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মানসিকতা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম বন্ধের জন্য যত তৎপর ছিল, সেরকম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাসের জন্য তৎপর হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়নি।

উল্লেখ্য যে, পার্শবর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকায় বাজেটের শতকরা ১৬-২০ ভাগ বরাদ্দ দেয়া হয়। ইউনেস্কো-আইএলও যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি নীতিমালা ঘোষণা দেন এবং সেই রেজুলেশনে বাংলাদেশ একমত পোষণ করে স্বাক্ষর করেছিলেন।

সেখানে বলা আছে, জিডিপির ৬ শতাংশ বা জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে শিক্ষাখাতে। গত ৪৯ বছরে, বাংলাদেশে বাজেটে জিডিপিতে শিক্ষাখাতে ২% এর কম। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এ দুটি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

ইউনেসকোর গবেষণায় দেখা গেছে যে আফ্রিকার দেশগুলোতে গড় উচ্চশিক্ষা এক বছর বাড়ানো সম্ভব হলে এ অঞ্চলের জিডিপি ০.৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেত।

আজকে বলা হচ্ছে, শিক্ষায় অর্থ ব্যয় খরচ নয়, বিনিয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ন্যুনতম সুবিধাদি নিশ্চিত করা এবং উচ্চশিক্ষায় বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা কোনোমতেই অর্থের অপচয় হবে না; লাভজনক ও সর্বোত্তম বিনিয়োগ হয়ে বরং তা রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য বিশেষ ফল বয়ে আনবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ থেকে ২৭ বছর আগে তার একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন- ‘আমরা যদি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সার্বিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করি, তাহলে শিক্ষাই হচ্ছে তার পূর্বশর্ত। বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী সাধনা ছিল বাংলার মানুষের স্বাধীনতা।

তিনি বলেছেন- আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযোগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকার পায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর তাঁর কন্যার অদম্য কর্মপ্রয়াসে বাংলাদেশ আজ শিকড় থেকে শিক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করতে যাচ্ছে। আর এ অগ্রযাত্রাকে টেকসই রূপ দিতে হলে অবশ্যই শিক্ষকদের জীবনযাত্রা, সমস্যা, প্রত্যাশা, চাহিদা আর প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে।

তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দ্যুতিময় অগ্রযাত্রায় শামিল হওয়া অত্যাবশ্যক। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত সে লক্ষ্য পূরণেই কাজ করা। তবে করোনাকালীন ও পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য পৃথক বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। তবে শিক্ষার বাজেট যায় হউক না কেন গুনগত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহযোগিতা এবং সুশাসনের জন্য বাজেট বাস্তবায়ন ও মনিটরিং প্রয়োজন।

লন্ডন‌ভি‌ত্তিক সাপ্তা‌হিক ম্যাগা‌জিন ‘টাইমস হায়ার এডু‌কেশন’ সম্প্রতি এ‌শিয়ার বিশ্ব‌বিদ্যালয়গু‌লো‌কে নি‌য়ে এক‌টি জ‌রিপ চা‌লি‌য়ে‌ছে। যা‌তে এ‌শিয়ার ৪৮৯টি সেরা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের নাম প্রকাশ পে‌য়ে‌ছে।

গত বছর এ তা‌লিকায় বাংলা‌দে‌শের কোন বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা ক‌রে নি‌তে না পার‌লেও এবার রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তা‌লিকায় অবধা‌রিতভা‌বে সর্বাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আ‌ছে জাপা‌নের ১১০টি, চী‌নের ৮১টি, ভার‌তের ৫৬টি, বিশ্ববিদ্যালয় তুর‌স্কের ৩৪টি, পা‌কিস্তানের ১৪টি এবং মা‌লয়েশিয়ার ১৩টি।

উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের ১৩১তম অবস্থানসহ ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান র‍্যাংকিং-এ ৪০০-র মধ্যে আছে। আর বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানও ৪০০-র মধ্যে নাই। এমনকি নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় ২৫১ থেকে ৩০০-র মধ্যে আছে। অনেক লোক, র‌্যাংকিং বিশ্বাস না করলেও এটা সত্যি যে, র‍্যাংকিং-এ থাকার সাথে একটি দেশের উচ্চ শিক্ষার মান ও প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব বোঝা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক যখন তাদের অধিকারগুলোর বিষয়ে সরকারি সকল ‍সুবিধার পাশাপাশি যেমন- শিক্ষকদের দ্রুত আপগ্রেডেশন বাস্তবায়ন, পৃথক বেতন স্কেল, গবেষনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট, প্রভাষক নিয়োগের জন্য পৃথক কর্ম কমিশন এবং শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিং ইন্সটিটিউটসহ শিক্ষকদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের জন্য প্রকাশ্যে কথা বলেন। অনেক শিক্ষকগণ জাতীয়ভাবে এ বিষয়টির নেতৃত্ব না দিতে পারলেও তারা ঠিক নিজ ক্যাম্পাসে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের দমানোর জন্য সরকার বিরোধী বা প্রশাসন বিরোধী বলে অপব্যাখ্যা করে যা খুবই দুঃখজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাই অনেক শিক্ষক এ বিষয়ে কথা বলতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যার ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে শিক্ষক রাজনীতিতে। অনেকের মনে শিক্ষক নেতৃত্ব সম্পর্কে থাকা যেসব সুপ্ত গুঞ্জন, অনাস্থা, অবিশ্বাস আর সন্দেহ, সেগুলো আরও শক্তভাবে দানা বাঁধবে- এতে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই।

বর্তমানে শিক্ষক সংগঠনগুলো সরকারের প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ না করার কারন তাদের নিজেদের পদ-পদবির লোভ। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের মেয়াদ উত্তীর্ন হলেও তারা পদ দখল করে আছে এবং এমনকি র্শীষ পদ একই লোকের কাছে বার বার বন্দী হওয়ায় উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঙ্খিত পরিবর্তন আসছে না ।

কয়েকবছর আগে একজন রাজনৈতিক নেতা একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আগে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণেত কাছে পরামর্শ নিতে যেত। আর এখন শিক্ষিকাগণ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদ পাওয়ার জন্য সুপারিশ নেন।”

তিনি আরও বলেন, “কোন প্রোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি থাকলে মনে হয় তারাই আমাদের থেকে বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি। তারা সরকারের গুনগান করার জন্য এতো লম্বা রাজনৈতিক ভাষন দেন যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তেমন কোন ভাষন দেওয়া লাগে না।”

সুতরাং যারা শিক্ষাবিদ হিসেবে বড় পদ দখল করে আছেন প্রকৃতপক্ষে তারা সাধারন শিক্ষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন না। বরংচ তারা ব্যস্ত পদ ধরে রাখতে বা পদের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেজুড়-ভিত্তিক দলকানা রাজনীতি অনুশীলন চর্চা নিয়ে ব্যস্ত।

তাই তারা সাধারণ শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করে না। আর একটি বিষয় লক্ষনীয় যে, আর কতিপয় শিক্ষাবিদ ভুরি ভুরি অন্য বিষয়ের কলাম লিখলেও শিক্ষকতা পেশা বিষয়গুলো খুব সহজে এগিয়ে এড়িয়ে যায় বলেও এতো বছরে দেশের উচ্চ শিক্ষা আগায়নি।

মোহাম্মদ শাহজালাল মোহাম্মদ শাহজালাল নামের একজন সহকর্মী গতকাল ইউট্যাবে একটি স্টাটাসে লিখেছিলেন যা নিম্নে তুলে ধরা হলো-“আমাদের সবচেয়ে বড় গজব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সুযোগ করে দিয়ে , অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে , শিক্ষকের কাজ শিক্ষা দেয়া , গবেষণা করা , জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দেয়া , এই কাজ বাদ দিয়ে দলীয় প্রধানদের স্তাবকতা করানো , মানুষের সৃজনশীল চিন্তাকে দলীয় দৃষ্টিতে বন্ধী করে গণমানুষের অধিকার কেড়ে নেয়া।

দলে দলে এজেন্ট খুলে বিশ্ববিদ্যালয় আজকে দলদাস তৈরির কারখানা , একজন শিক্ষক জনগণের স্বার্থে সবচেয়ে বেশি নৈতিক হক এবং সত্য কথা বলবেন , এই জাতির মুক্তি নিহিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের দলীয় রাজনীতি বন্ধে , রাজনীতি যে কেউ করতে পারে , কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দলীয় ব্যানারে রাজনীতি করতে পারেন না , এই দলীয় রাজনীতি আমাদের অন্ধকারে নিয়ে গেছে, আমাদের অনতিবিলম্বে জাতির স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি থেকে ইস্তফা দেয়া, সক্রিয় রাজনীতি করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে করেন , আল্লাহর ওয়াস্তে এইসব ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতি বন্ধ করেন , নিজের শিক্ষা আর বিবেককে এইভাবে বিক্রি করবেন না , অগণিত মানুষের স্বপ্নের সাথে প্রতারণা করবেন না , জেগে উঠুন। নিজের বিবেককে অমানবিক করবেন না , সত্য ন্যায় আর কল্যাণের পথে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা জাগ্রত রাখুন।

মহান আল্লাহ আপনাদের সহায় হন.” কথাগুলো খুবই সত্যি। তবে সেটি রাজনীতি নয় অপরাজনীতি বা দল কানা রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতি করলে সেটা তো জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে এর কোন প্রভাব দেখি।

আমাদের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিচিং বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রকৃত গবেষক তৈরির করার পরিবর্তে গাইড মুখস্থ করার বিসিএস ক্যাডার বা ছাত্র নেতা বা একাডেমিক পড়া মুখস্থ ভাল রেজাল্টধারী দক্ষতাবিহীন লাখ লাখ বেকার গ্রাজুয়েট তৈরি হচ্ছে যা বিশ্ববিদ্যালয় কখনো এড়িয়ে যেতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে অন্যতম একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো- একাডেমিক কাউন্সিল। এটিকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বলতে পারেন। আমি দেখেছি শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক ভাল ভাল প্রস্তাব এমনকি সরকারের অনেক ভাল ভাল প্রস্তাবও কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষকদের জন্য বাতিল হয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ২য় শিল্প বিপ্লবের উপযোগি বেকার গ্রাজুয়েট তৈরি করছি । অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন মানবসম্পদ সৃষ্টি করা, যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে নিজ নিজ দেশের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণেত সদিচ্ছা অভাবের পাশাপাশি এটার জন্য অনেকাংশে দায়ী একাডেমিক কাউন্সিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো-বিভাগ কোন একাডেমিক বিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিল প্রস্তাব দিলে এর সমর্থন প্রয়োজন অন্য বিভাগের শিক্ষিকাগণ যা হাস্যকরও বটে। এ ধরনের একাডেমিক কাউন্সিল জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। শিক্ষা যদি জাতীর মেরুদন্ড হয় আমার তো মনে হয় এই মেরুদন্ডে আমাদের প্রধান সমস্যা ।

বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা জন্য যখন দাবি করে তখন তাদেরকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ফমুর্লায় রেখে আর্থিক সুবিধা বঞ্ছিত করা হয়। আবার যখন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বের অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা চিন্তা করে পৃথক বেতন স্কেলের বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয় তখন সরকারি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি বলে অবহিত করা হয়।

স্বাধীনতার এতো বছর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি নাকি সরকারি কর্মচারি দিধা দ্বন্দ্বে রাখা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। উল্লেখ্য, সরকার কিন্তু সামরিক বাহিনীর পৃথক বেতন স্কেল ঠিকই বাস্তবায়ন করেছেন। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করতে অসুবিধা কোথায়? সত্যি কথা বলতে কী, বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্বের বিদ্যালয় এটা অনেকে বুঝেও না বোঝার ভান করে।

বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেখে কোন প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়েছে এখন পর্যন্ত কোন রেকর্ড নাই। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করে উচ্চ শিক্ষা মান উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সদিচ্ছা এবং সরকারের সহযোগিতা মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। তবে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার জন্য কোন মতেই শিক্ষকদের দায়ী করা সমীচিত হবে না।

অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি, জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা। আর শক্তিশালী জনশক্তি গড়ে তুলতে অপরিহার্য একটি জনবান্ধন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। সুতরাং প্রত্যেকটি খাত একটি আরেকটির পরিপূরক। আমাদের মাঝে মতবিরোধ থাকবে, থাকবে নেত্রীত্বের প্রতিযোগিতা, কিন্তু উচ্চ শিক্ষার উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে যেতে হবে।

আশা করি, সরকার উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সরকারি সকল সুবিধা দেওয়ার নিশ্চয়তা, প্রভাষক জন্য নিয়োগের পৃথক কর্ম কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, পৃথক বেতন স্কেল এবং গবেষনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন।

অন্যথায় উচ্চ শিক্ষা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বঙ্গবন্ধুকন্যা ন্যায়সঙ্গত বিষয়াদি মেনে নেবেন এবং শিক্ষকদের অবস্থান ও মর্যাদার কথা ভেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশ এমন কি প্রতিবেশি দেশের তুলনায় সকল প্রার্থিত সুবিধাদি নিশ্চিত করবেন।


লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *