উন্নয়নের প্রচারণা : শাসকগোষ্ঠী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রোপাগান্ডা

উন্নয়নের প্রচারণা : শাসকগোষ্ঠী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রোপাগান্ডা

জি. কে. সাদিক


উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে। আমি এই লেখার মাধ্যমে সেই বিতর্কে অংশ নিলাম মাত্র। আশা এই যে, দেশে সাধারণ মানুষ যেন বুঝতে পারে আসলে উন্নয়ন বলতে কী বুঝায়। শাসকশ্রেণি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যে উন্নয়নের বুলি আওড়ান ও সবক দেন সেটা কতটা সত্য।

শাসকশ্রেণি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে চুপ রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে লাগাতার উন্নয়নের প্রোপাগান্ডা (উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক প্রচারণা) চালানো এবং জনমনে এই বিশ্বাস স্থাপন করানো যে একমাত্র তারাই উন্নয়নের কাণ্ডারী। তাই উন্নয়ন চাইলে তাদেরকেই সমর্থন করা উচিত। দীর্ঘ সময় লাগাতার প্রচারের ফলে এই প্রোপাগান্ডা অনেকটাই সফল হয়।

কিন্তু সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজের কিছু মানুষ যারা প্রকৃতই উন্নয়নের গোড়ার কথাটা জানে এবং তারা সেটা প্রকাশ করে দেয়। তবে এই আওয়াজটা হয় খুব ক্ষীণ। ‘ম্যাস পিপুল’ তথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। ফলে ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠী বাদে সকলেই ‘উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক প্রচার’কেই সত্য বলে ধরে নেয়।

যার ফলে শাসক বা কর্তৃপক্ষ তাদের সব ধরণের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সাধারণ মানুষের কাছে এক ধরণের বৈধতা আদায় করে নেয়। কারণ সাধারণ মানুষ দৃশ্যমান ছোটখাটো কোনো অবনতি, শোষণ কিম্বা নিপীড়ন মেনে নেয় স্থায়ী উন্নয়নের আশায়।

‘উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক প্রোপাগান্ডা’ শাসকদের বা কর্তৃপক্ষের যাবতীয় কাজের জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই প্রোপাগান্ডাকে ব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডকেও জনগণের কাছ থেখে বৈধ করে নেয়। যেমন ফিলিপাইন মাদক বিরোধী অভিযানের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা; বাংলাদেশে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সন্ত্রাস বন্ধের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা; ভারতে ধর্ষণ ও সন্ত্রাস বন্ধের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা; চীনে আইন করে মানুষের মানবাধিকার হরণ ইত্যাদি তারই উদাহরণ।

এমন হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে গণদাবি উঠেনি। কারণ এগুলো মানুষের নিরাপত্তা, দেশের শান্তি ও উন্নয়নের নাম করেই করা হয়েছে।
শাসকগোষ্ঠীর এই প্রচারণায় সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রেখেছে। অথচ উক্ত দেশে মাদক, সন্ত্রাস বা ধর্ষণ কোনোটাই বন্ধ হয়নি।

উন্নয়নের প্রোপাগান্ডা সেই দেশে খুব সহজেই করা যায় যে দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী নয়; সাধারণ মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের শিক্ষা নাই তথা তারা কেবল ভোট দেয়াকেই গণতন্ত্র মনে করে। উক্ত দেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন নয়; তবে সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা অনেক থাকে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলো শাসকগোষ্ঠীর কিম্বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও হস্তাক্ষেপ মুক্ত নয়।

নিয়মতি সেখানে রাষ্ট্রী বাহিনীগুলোর কড়া নজরদারি ও সেন্সর থাকে। এটা এমন কৌশলে করা হয় যেটা সচারচর সাধারণ মানুষের সামনে প্রকাশ পায় না। এমনকি সংবাদমাধ্যমে যারা কর্মরত আছে তারা বিষয়টা জেনেও কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ তারা অনেকটাই ভিক্টিম। অন্যদিকে বর্তমানে সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিকানাও সাংবাদিকদের হাতে নেই। বড় বড় পুঁজিপতিরাই সংবাদমাধ্যমের মালিক।

তারা আবার শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষেরই অংশ। ফলে সংবাদমাধ্যমেও প্রকৃত সত্য আসে না। উল্টো সংবাদমাধ্যমগুলোই শাসকগোষ্ঠীর ও প্রতিষ্ঠান কতর্ৃপক্ষের ‘উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক প্রোপাগান্ডা’ চালায়। ফলে গোটা পরিস্থিতিই হয় খুব সুক্ষ ও গভীরভাবে নিয়ন্ত্রিত। যেখানে সংবাদমাধ্যমে সচেতন মানুষের বিশ্লেষণী সত্য প্রকাশ করা হয় না।

সংবাদমাধ্যমগুলো তথ্য তথা খবর সংগ্রহের জন্য মাঠপর্যায়ে কাজ করে না বা করলেও যৎসামান্য। তারা শাসকগোষ্ঠীর কিম্বা প্রতিষ্ঠান কতর্ৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলন বা তাদের প্রদত্ত প্রচারপত্রকেই খবরের সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে প্রকৃত সত্য মাঠেই থাকে কখনও প্রকাশিত হয় না।

যখন সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃত তথ্য অপ্রকাশিত থাকে এবং সব ধরণের প্রচার মাধ্যমে বারংবার শাসকগোষ্ঠীর বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের জরিপকৃত উন্নয়নের কথাই প্রচার করা হয় তখন সাধারণ মানুষ সেটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। কারণ সংবাদমাধ্যমের প্রচারকে কখনও ব্যক্তি প্রচার দিয়ে মোকাবেলা করা যায় না।

শাসকগোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যেখানে তাদের উন্নয়নের বুলি সব সময় প্রচার মাধ্যমের প্রশ্নহীনভাবে প্রচার করছে সেখানে মাঠপর্যায়ে ব্যক্তির বা কোন গোষ্ঠীর অনুসন্ধান এবং সেটার প্রচার মানুষের কাছে পেঁৗছায় না। পেঁৗছালেও সেটা শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক প্রোপাগান্ডার মুখে টিকতে পারে না। ফলে দিন শেষে প্রকৃত সত্য অল্প কিছু মানুষ বাদে সাধারণ মানুষের অগোচরেই থেকে যায়।

সাধারণ মানুষের কাছে যদি প্রশ্ন করা হয় যে আপনি কেমন শাসক চান। বা দেশের জন্য কোন ধরণে সরকার পছন্দ করেন। তখন তাদের উত্তর হয়, যে শাসক বা সরকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্ত নিশ্চিত করবে এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। উক্ত কাজগুলো করতে গিয়ে শাসক বা সরকার যদি কঠোরও হয় সেটা সাধারণ মানুষ মেনে নিতে প্রস্তুত। ২০১৬ সালে বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক মূলবোধ নিয়ে এক জরিপে এমনটাই দেখা গেছে। ইয়োরোপ ও আমেরিকার ৬০ বছর বয়সীরা মনে করেন যে সুন্দর শাসনব্যবস্থার জন্য গণতন্ত্রই ভালো।

অন্যদিকে যাদের বয়স ৩০ এর নিচে তাদের অর্ধেক এটা মানতে নারাজ। আমেরিকার এক-চতুর্থাংশ মনে করে দেশ পরিচালনার জন্য ‘প্রচলিত গণতন্ত্র’ বাজে পদ্ধতি। ১৭ শতাংশ ইয়োরোপীয় এই মতের সমার্থক। জার্মানি, স্পেন, জাপান ও আমেরিকার ৪০ শতাংশ জনগণ মনে করে তাদের জন্য একজন শক্তিধর রাষ্ট্রনায়কের সংসদ কিম্বা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষতায় থাকার চেয়ে তার উচিত কোঠর হস্তে শাসন চালিয়ে যাওয়া। অন্যদিকে গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৪৩ শতাংশ মানুষ মনে করে যে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সমাজতন্ত্রই অধিকরত ভালো ব্যবস্থা।

মোট কথা হচ্ছে সাধারণ মানুষ চায় নিরাপদ জীবনের গ্যারান্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এর জন্য প্রয়োজনে সাময়িক কিছু অসুবিধার জন্য ধৈর্য্য ধরতেও রাজি। সাধারণ মানুষের এই যে ছাড় দেয়ার মানসিকতা এটাই হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর কিম্বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের জন্য জনমনস্ততত্ত্বকে নিজের ‘উন্নয়নের প্রোপাগান্ডা’ বিশ্বাস করিয়ে দেয়ার মওকা। আর এটা করতে তাদের তেমন বেগ পেতে হয় না। যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

আসলে উন্নয়ন বিষয়টা কী বা কেমন? বিষয়টাকে সরাসরি সংজ্ঞায়ন করা কঠিন। কারণ উন্নয়নের ধারণা সব দেশে ও সব ব্যবস্থায় এক নয়। যেমন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উন্নয়ন মানে হচ্ছে অর্থনৈতিক সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করাটা হচ্ছে উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য। এবং এটা সবার জন্য হবে সমান ও বিনামূল্যে। সে দায়িত্ব হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির তথা সর্বহারাশ্রেণির প্রতিনিধিদের।

তাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন যে অর্থবহন করে পূঁজিবাদী সমাজের তেমন নয়। এখানে ব্যক্তির একক বিকাশই উন্নয়নের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ১ কোটি জনসংখ্যার একটা দেশে ১০ লাখ মানুষ যদি বিলিয়ন ডলারের মালিক হয় বার বাকি ৯০ শতাংশ মানুষের ইনকাম যদি হয় কোন রকমে দিন চলে যাওয়ার মতো এমন রাষ্ট্রে যখন শাসনগোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান কতর্ৃক উন্নয়নে হিসাব বা দেশের মোট অর্থনীতির অগ্রগতির হিসাব করা হয় তখন সবার আয় একত্রে যেটা হয় সেটাই হবে উন্নয়নের হিসাব।

আরেকটু স্পষ্ট করলে বিষয়টা এমন যে, একটা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকের ইনকাম মাসে ৫ কোটি টাকা। এবং সেই প্রতিষ্ঠানের গেইটের কাছে একটা চায়ের দোকনীর মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা। এই দুজনের গড় আয়ের হিসাবটাই হবে শাসকগোষ্ঠীর ‘উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক হিসাব’। এই দুজনের মোট আয় হচ্ছে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং দু জনের গড় আয় হচ্ছে ২ কোটি ৫০ লক্ষ ৫ হাজার টাকা করে। যখন শাসকগোষ্ঠী ‘উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক প্রোপাগান্ডা’ চালাবে তখন মাথাপিছু আয়ের হিসাবে তখন ওই শিল্পপতির আয় এবং চা বিক্রেতার আয় সমান। এই হচ্ছে একটি পূঁজিবাদী রাষ্ট্রের নাগরিকদের আয়-উপর্জান নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর ‘উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক হিসাব’। সংবাদমাধ্যমগুলোতে উন্নয়নের এই প্রচার প্রচারণা উপরোক্ত ব্যাখ্যা কখনই দেখা যায় না। যেটা সে দেশের সাধারণ মানুষ রাত-দিন দেখে, শুনে ও পড়ে। যার ফলে তারা উন্নয়নের এই ভৌতিক হিসাব কখনই জানতে পারে না।

এটা তো গেল উন্নয়নের ব্যক্তি হিসাব। শাসকগোষ্ঠী তথা প্রতিষ্ঠান কতর্ৃপক্ষের উন্নয়নের আরও দিক রয়েছে। যেমন পানি প্রবাহের নালা বা খাল বরাট করে বড় বড় রাস্তা নির্মাণ করা। সবুজ বন উজার করে বন্যপ্রাণীদের আবাস ও প্রজনন কেন্দ্র ধ্বংস করে বড় বড় মেগা প্রজেক্ট দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিমার্ণ। নদী বা সমুদ্রের পরিবেশ ধ্বংস করে বন্দর নির্মাণ। ট্যানেল কিম্বা টলটলে নির্মল পানির বহতা নদীর বুকে ইয়া বড় সেতু তৈরি করা। নগরের গাছ কেটে গোটা শহর জুড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে দু ধারে হরেক রঙের লাইটিং করা।

দেশীয় পণ্য ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে খাদে ঠেলে দিয়ে বিদেশী পণ্যে বিশাল বিশাল শপিংমহল তৈরি করা। উচু উচু টাওয়ার কিম্বা ভবন নির্মাণ করে ছাদ বাগানে উৎসাহিত করা। জন নিরাপত্তার জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা করা এবং সেই রাস্তা ব্যবহার করে অভিজাতশ্রেণির সুরম্য অট্টালিকার জন্য পাহাড়ের বৃক্ষ কেটে সুন্দর ও নান্দনিক ফার্নিচার তৈরি করা। এবং নিরাপত্তার জন্য সেখানে সেনা ছাউনি নির্মাণ করা। সবুজ গ্রামকে নগর বানিয়ে সেখানে কৃত্তিম টিলা সৃষ্টি করে গাছ লাগিয়ে সেগুলোকে কেটে-ছেঁটে নানা ডিজাইনে পার্ক করা। ধ্বংস হয়ে যাওয়া বনের প্রাণীগুলোকে ধরে এনে চিড়িয়াখানা তৈরি করে সেখানে বড়-ছোট সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে লেখে দেয়া যে, ‘আসুন সবাই মিলে সবুজ বনায়ণ করি জীব বৈচিত্র রক্ষা করি’।

যা দেখলে মানুষের চোখ তাতিয়ে যাবে, সাধারণ মানুষ মোহপ্রেমে ঘোরের মধ্যে পরে যাবে। আর এসবই করা হবে জনগণের করের টাকায়। আবার এগুলো জনগণের জন্য উন্মুক্তও করা হবে টিকিট মূল্য রেখে। যেখানে মানুষ আনন্দ বিনোদন করবে আর ভুলে থাকবে সব কিছু। আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোতে এগুলোও উন্নয়নের অংশ; বাংলাদেশেও।

অন্যদিকে উন্নয়নের আরও একটি হিসাব হচ্ছে এই, মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নিত্য প্রয়োজনী পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিপুল হারে রাজস্ব আহরণ করে বিশাল রির্জাভ দেখানো। এটা করতে গিয়ে চিকিৎসা ও শিক্ষাকেও বাজারে পণ্যের মতো দামাদামিতে ছেড়ে দেয়া। এদিকে শহর-নগর বন্দর, গ্রামের-বনে, নদীর বুকে, পাহাড়ের চূড়ায় সর্বত্র উন্নয়ন অন্যদিকে রিজার্ভের প্রতিষ্ঠানিক হিসাব দেখিয়ে দেশকে উন্নতির এক স্তর থেকে অন্য স্তরে স্তারান্বিত করে সংবাদমাধ্যমে সর্বত্র জনগণের কাঙ্খিত উন্নয়নের স্বপ্ন প্রায় পৌঁছে যাওয়া প্রত্যায় ব্যক্ত করে সাথে থাকার ও ভরসা রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রচার করাটা সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক দেশে ‘উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক প্রচারকারী’ অগণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী কিম্বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

এই দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসকগোষ্ঠীর অনুগত প্রশাসক তথা ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়। যার ফলে শাকসগোষ্ঠী কর্তৃক যে ধরণের উন্নয়নের প্রোপাগান্ডা চালানো হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোও সে ধরণের প্রচারণার উৎপাদন সম্পর্কের পুনরুৎপাদন করে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বলতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ বুঝেন বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্ধ্বমুখী ভবন সম্প্রসরণ করা। মেগা প্রজেক্ট এনে বিশাল বিশাল ভবন নির্মাণ করা।

শিক্ষাকদের জন্য উন্নতমানের গাড়ি ক্রয় করা। শিক্ষকদের ও কর্মকর্তাদের রুমে এসি লাগানো। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে নজরদারি প্রতিষ্ঠার জন্য সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির শেকড় নষ্ট করে দেয়া। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দেয়া কিম্বা ছাত্র সংসদের অধ্যাদেশই না রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য দৃষ্টিনন্দন মেডিকেল ভবন নির্মাণ করা কিন্তু চিকিৎসা বাজেট না দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পণ্য উপৎপাদন না করেও অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি করার মতো দুর্দান্ত ক্যাপাসিটি থাকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর। সেটা হয় ভর্তি ফি থেকে শুরু করে নানান খাতে ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে।

এই ধরণের অপকর্মের জন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ টেনে থাকে। অথচ তারা জানেও না যে শিক্ষা পণ্য নয়। তাই পণ্যের মতো শিক্ষার মূল্য করা যায় না। সেখানে ফি বাড়ানো কমানো তো অনেক পরের প্রসঙ্গ। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে নাম মাত্র বরাদ্দের বিগ বাজেট নিয়ে আসাকেও উন্নয়নের অংশ মনে করা হয়। গবেষণায় বরাদ্দ না থাকার ফলে ল্যাবরেটরিতে ধুলো জমে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা গবেষণার কাজ বাদ দিয়ে দলীয় লেজুড়বুত্তির রাজনীতি থেকে শুরু করে নিয়োগ বাণিজ্য ও অহরহ নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিগুলো হয় নির্লজ্জ ও সীমাহীন দুর্নীতিবাজ। এমন দুর্নীতিবাজ যে দুর্নীতি করে কিন্তু কোনো চিহ্ন রাখে না। বা নিজে সরাসরি দুর্নীতি করে না কিন্তু তার চারপাশে থাকা সবাইকে সুযোগ করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনগুলোও শাসকগোষ্ঠীর ন্যায় অনুগত সংবাদমাধ্যমকর্মী পোষেণ।

যার মাধ্যমে তাদের অপকর্ম আড়াল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেবল দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রোপাগান্ডা চালিয়ে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে। শিক্ষার্থীদের দিয়ে নিজেদের নামে প্রচারণাও করিয়ে থাকেন শাসকগোষ্ঠীর মতো।

তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে শাসকগোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর চরিত্র এমনই হয়। যার ফলে দেশের সাধারণ মানুষ যেমন জানে না উন্নয়ন আসলে কী তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীও জানে না বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত উন্নয়ন বলতে আসলে কী বুঝায়।

যদিও এই লেখকও প্রকৃত উন্নয়ন বলতে আসলে কী বুঝায় সে বিষয়টি এই লেখায় ইঙ্গিতপূর্ণ ও অস্পষ্ট রেখে দিয়েছেন। কারণ তিনিও আসলে বুঝেন না যে আসল উন্নয়ন মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাকে পণ্যমূল্যের উর্ধ্বে রাখা নাকি এগুলোও বাজারে বিক্রি করে উন্নয়ন করা কিম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়িয়ে গবেষণায় বরাদ্দ না দিয়েও উন্নয়ন করা যায়।

সাংবাদিক ও কলাম লেখক, কুষ্টিয়া।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *