আহসান আহমেদ রোডের নামকরা গ্রীন গার্ডেন রেস্তরাঁয় ওয়েটার এর কাজ করে নুরু।গতবছর নড়াইলের এক গ্রাম থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। এবার শহরে এসেছে পড়াশুনো করতে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে নুরুর সবচেয়ে জরুরি ছিলো একটা চাকরি পাওয়া।
নুরুর বাবা ৭ বছর আগেই মারা গেছেন। নুরুর মা গ্রামের বাড়িতে দর্জির কাজ করে। নুরুর লেখাপড়া আর নিজের সব খরচ তাকে নিজেকেই করতে হয়। নুরু কলেজের পাশেই মুড়িটোলায় মেসে থাকে। গ্রীন গার্ডেন হোটেলে পার্টটাইম জব করার জন্য নুরু বিকেলে হোটেলে এলো।
হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে নুরু ওয়েটারের কাজ নিয়ে নিলো। বিকেল পাচঁটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তাকে কাজ করতে হবে।মাসে বেতন মাত্র ১২০০ টাকা।এতো কম বেতনেও নুরু রাজি কাজটা নিতে কারন তার কাজ পাওয়া জরুরি। কাজের প্রথম দিনেই নুরু বুঝে গিয়েছিল যে এই হোটেলে কাজের চাপটা বেশ। নুরু তার কাজে খুবই মনযোগী ছিল।
ওদিকে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে নুরু একটা জিনিস দেখল, তার সহপাঠীরা সবাই দামি দামি মোবাইল ব্যাবহার করছে। পোশাকআশাকেও খুব বিলাসিতা সবার মধ্যে।যদিও নুরু গ্রাম থেকে আসার সময় পলিথিনের ঐ ছোট ব্যাগে মাত্র দুইটা শার্ট আর একটা প্যান্ট নিয়ে এসেছিলো। নুরু ক্লাসে সবার থেকে বেশ ভিন্ন ছিলো। ক্লাসের মেয়েরা ভাবে নুরু পাগল। আসলে নুরুর এরূপ চলাফেরা মানে সাদামাটা জীবনযাপন সবার কাছে ফালতু হলেও এটার মূল কারন দারিদ্রতা।
কলেজে নুরুর কোনো ভালো ফ্রেন্ড নেই। নুরুকে নিয়ে ক্লাসের একদল বেয়াদব ছেলেমেয়ে সর্বদা হাসাহাসি করে। এই ব্যস্ত মুখরিত বাজে শহরটায় নুরুর মনের দুঃখ গুলো কেউ বোঝে না। টিফিন টাইমে ক্লাস ফাকাঁ সবাই জাফর মামার ক্যান্টিনে টিফিন করায় ব্যাস্ত। নুরু ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসা। নুরু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদেঁ, তার কেনো যেন খুব পরিবারের কথা মনে পরছে। এভাবেই নুরুর জীবন চলে।
দিনটা শীতকালের, হয়তো নভেম্বর মাস সন্ধ্যের সময় গ্রীন গার্ডেন হোটেলের ২৪ নম্বর টেবিলে অনেকজন তরুন তরুনীর আগমন। নুরু ২৪ নম্বর টেবিলের ওয়েটার..তরুণ তরুণীরা ছিলো নুরুর কলেজের ক্লাসমেট রাজিব, রাহাত, তাহমি, শ্রাবণী, সাফরান, অরিত্রিকা আর জেনিফার। সবাই এক পলক দৃষ্টিতে নুরুর দিকে চেয়ে আছে। নুরু যে তাদের সাথে পড়াশুনোর পাশাপাশি ওয়েটারের কাজ করে এটা দেখে সবাই অবাক।
এরকম সিচুয়েশনে নুরু বেশ লজ্জিত। নিজেকে খুব নগন্য মনে হলো নুরুর। যাই হোক সবাই কফি আর স্যান্ডুইচ খেয়ে চলে গেল শপিং করতে। নুরু কী মানুষ না? নুরুরও তো ইচ্ছা হয় সবার সাথে ঘুড়বে, খাওয়াদাওয়া করবে, লাইফটা ইনজয় করবে। তবে নুরুর এই ভাবনা গুলো বৃথা যার কারন তার অবস্থা আর দারিদ্রতা। নুরুর তো একটা দামি আ্যনড্রয়েড মোবাইল নেই। নেই ভালো একটা জামা। নুরু কেমন যেন অগোছালো হয়ে গেছে। নুরুর মতো মানুষদের নিয়ে হাসি ঠাট্টা করাটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।
তবুও কীভাবে যেন নুরুর দুঃখ ঘেরা দিন গুলো চোখের পলকেই চলে যাচ্ছিল।কলেজে ক্লাস শেষে কেউ ক্যাম্পাসে আড্ডা দিচ্ছে নয়তো কেউ ক্যান্টিনে বসে আছে।নুরু ক্লাস শেষে কলেজের কোণায় পুকুরপাড়ে বসে আছে।পুকুরের ঘাট বাধানো সিড়িঁতে একটা ছেলে বসা। তার হাতে একটা বই, নিশ্চই কোনো উপন্যাস এর বই হবে। নুরু আজকে হোটেল থেকে বেতন পেয়েছে, বাড়িতে তার মায়ের কাছে অল্প কিছু টাকা পাঠাতে হবে।তবে নুরুর কাছে মোবাইল নেই।
নুরু খেয়াল করে দেখল তার পাশে বসে থাকা ছেলেটার জিন্স প্যান্টের পকেটটা একটু উচুঁ। অর্থাৎ তার কাছে মোবাইল আছে। নুরু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল –
নুরু – ভাই একটা সাহায্য করতে পারবেন?
ছেলেটা বলল, ‘আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। কী নাম তোমার?’
নুরু- রফিক হোসেন নুরু।
ছেলেটা বলল – আমি রুদ্র আলিফ। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি।যাইহোক কী সাহায্য দরকার বলো?
নুরু – আপনার মোবাইলটা একটু দিতে পারবেন? আমার গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাবো বিকাশের মাধ্যমে।
রুদ্র – শিওর। চলো তাহলে বিকাশের দোকানে..!
নুরু – জি ভাই চলেন।
যেতে যেতে নুরু তার জীবনের প্রতিটা ঘটনা রদ্রকে বলল। রুদ্র সবটা শুনে অবাক হয়ে বলল – তুমি ভাই জীবন সংগ্রাম করছো।
নুরু – ভাই আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে উপকার করার জন্য।
নুরুর জীবনের প্রতিটি ক্ষণকাটে দুঃখ আর না পাওয়ার লগ্নে।তবে এই শহরে অনেক মানুষ বসবাস করে, কেউ নুরুর কষ্ট বোঝে না বরং মানুষ তার চলাফেরা নিয়ে বিদ্রপ প্রদর্শন করে,প্রতিটা মানুষ চায় ভালো ভাবে জীবন কাটাতে। তবে যারা দারিদ্রতার বোঝা নিয়ে জীবন সংগ্রামে নামে তাদের স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকেই থাকে তা বাস্তব হয়ে ওঠে না। আমরা নুরুর মতো মানুষদের উপকার করার চেষ্টা করব।