এমন ঈদ দেখেনি কেউ আগে

এমন ঈদ দেখেনি কেউ আগে

মো. মজনুর রশিদ


ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। মুসলিম বিশ্বে ঈদের নতুন চাঁদ দেখার সাথে সাথেই চারদিকে ছড়িয়ে পরে ঈদের অনাবিল আনন্দ। ঈদ মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।

নতুন পোশাক পরিধান করা, পাড়া প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করা, ভালো ও উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করা, পারস্পারিক ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা, ঈদগাহে বড় জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করা, ঈদগাহ মাঠের পাশে শিশুদের আনন্দ উৎসব, বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, ধনী ও স্বল্প আয়ের মানুষের মনে খুশির হাসির নামই হলো বাংলার ঈদ আনন্দ।

তবে খুশির ঈদের আনন্দ বেশি অনুভুত হয় শিশু, কিশোর ও যুবকদের মাঝে। বয়স্করা সেসব দিন অতীতে ফেলে এসেছে। কর্ম ব্যস্ত ও বাসা-বাড়ির অন্য সদস্যদের আনন্দ উৎযাপনের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায় তাঁরা এবং পরিবারে অর্থের যোগান দেয়া ও না দেয়ার উপলক্ষ হয়ে থাকে তারা। ফলে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তির ঈদ আনন্দ শিশু কিশোরদের ঈদ আনন্দ থেকে একটু ভিন্ন ধাঁচের হয়ে থাকে। তবে ঈদের আনন্দ সবার মাঝেই কম বেশি থেকে থাকে। বাঙ্গালির ঘরের ঈদ বলে কথা! ঈদ মোবারক।

ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এই দুটি ঈদ মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের দিন। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এর বিশেষ কড়াকড়ির মধ্যে উদযাপিত হতে যাচ্ছে এ বছরের (২০২০ সালের) ঈদ আনন্দ।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুশিয়ারি ও আইইডিসিআর এর স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে এ বছরে ঈদের জামাত সীমিত পর্যায়ে করার আহবান জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সেই সাথে ঈদগাহে বা খোলা মাঠে বড় জমায়েত না করে মসজিদে ঈদের জামাত আদায় করার নির্দেশনা জারি করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। নিজ নিজ পাড়া বা মহল্লার মসজিদেই এবার ঈদের নামাজ পড়তে হবে সকলকে।

সেই সাথে ঈদ নামাজ শেষে পারস্পারিক কোলাকুলি ও হ্যান্ডসেক করা থেকেও বিরত থাকার আহ্বান রয়েছে। ফলে থাকছে না মুসলিম উম্মার চিরাচরিত ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ব্যবহার! সামাজিক না বরং শারীরিকভাবে দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যাবে।

সংগত কারণেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোভিড-১৯ এর কারণে ঈদের জামাতের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কোনো কোনো দেশে রয়েছে সীমিত পর্যায়ে ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি। আবার কোনো দেশে ঈদের দিনে কারফিউ জারি করা হয়েছে (সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ)। মোট কথা সারা বিশ্বে এ বছরের ঈদ আনন্দ উদযাপিত হচ্ছে ঘর বন্দি অবস্থায়। একই সময়ে যা বিশ্ব দেখেনি এমনটি আগে কখনো।

সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে সকলকেই মেনে চলতে হবে সরকারের দেয়া কিছু বিধি নিষেধ। রাষ্ট্র তার জনগণের নিরাপত্তার জন্য কখনো কখনো এমন কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। যা জনগণকে স্বাচ্ছন্দে এসব নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়। এসব মেনে চলার মাধ্যমে নাগরিকের দায়িত্ব ও সুনাগরিকের পরিচয় বহন করে। এর মধ্যে রাষ্ট্র ও জনগনের সার্বিক মঙ্গল নিহিত থাকে।

কিন্তু সব সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এক রকম না। এছাড়াও রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক গন্ডির মধ্যে বিনোদন ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি। এসব নিয়ম ভঙ্গের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে হাদিসেও উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো মহামারীর সময় মানুষ যেনো তাঁদের নিজ নিজ ঘর বা বাসা-বাড়িতে অবস্থান করে নিজেকে নিরাপদ রাখে।

কোভিড-১৯ এর কারণে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ অনেক ক্ষেত্রে জনগণ কম মান্য করে চলেছে। এর ফলে দেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেতে পারে। যে কারণে করোনা ভাইরাস সনাক্তের প্রায় ৭৫- ৮০ তম দিনে এসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে (তথ্য সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিন)।

পায়ে হেঁটে গার্মেন্টস কর্মীদের ঢাকা গমন, ঢাকার রাস্তায় মানুষ ও ব্যক্তিগত পরিবহনের চাপ, ঈদের আগে মার্কেটে সাধারণ মানুষের উপচে পরা ভিড়, স্বাস্থ্য বিধি না মানার প্রবণতা, আবার ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে ঢাকা ফেরত গ্রামমুখী মানুষের গাদাগাদি করে ফেরি পরাপারের দৃশ্য (তথ্য সূত্র: বিভিন্ন সংবাদ মিডিয়া, মে ২০২০) বর্তমানে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে অনেকে মনে করে। অপর দিকে ইউরোপ আমেরিকার তুলনায় করোনা ভাইরাসে বাংলাদেশে শিশু, কিশোর ও যুবকের মৃত্যুর হার বেশি (তথ্য সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিন এপ্রিল-মে ২০২০)।

“চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্যা টাইম অব কোভিড-১৯” শিরোনামে শিশু ও তরুণদের ওপর করোনা পরিস্থিতির প্রভাব জানতে ওয়াল্ড ভিশন জরিপ বলছে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে ৭১ শতাংশ তরুণ নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। ৯১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ, রাগ, শঙ্কাসহ নানা মানসিক চাপ (তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল ২০২০)।

অপরদিকে ঈদের ক’দিন পূর্বে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নিয়ে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণি ঝড় ‘আম্পান’ (তথ্য সূত্র: আবহাওয় অধিদপ্তর, সময় সংবাদ, ২০ মে ২০২০)। স্বরণ কালের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এর তান্ডবে উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ জেলায় ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির চিহ্ন রেখে গেছে। আবারও সুন্দরবন বুক চিতিয়ে ভয়াবহ ক্ষতির মুখ থেকে রক্ষা করল বাংলাদেশকে (তথ্য সূত্র: সময় সংবাদ, ২১ এপ্রিল ২০২০)।

তবুও এই ক্ষতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক, দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য জীবন ধারণ হয়ে পড়েছে আরো কঠিন। কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাসের এমন মহামারীর কালে ‘আম্পান’ বাংলাদেশের জন্য ‘মরার ওপর খরার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন মানুষের অবস্থা হয়ে পরেছে দুর্বিষহ।

যদিও সরকার এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশংসনীয় সক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। সামাজিক বাস্তবতার এমন অবস্থায় মানব সমাজ তথা দেশবাসী পড়েছে নতুন অচেনা উভয় সংকটে। ঘরে থাকা বড় দায়, বাহির হলে মৃত্যুর ভয়! এরই মাঝে উদযাপিত হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ আনন্দ। ঈদ মোবারক।

নানা প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট দুর্যোগে ব্যহত হচ্ছে সরকারের গৃহীত টেকসই উন্নয়ন নীতি। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতি নীতি মেনে চলতে কিছু আইন ও সামাজিক বিধি বিধান মান্য করার প্রবণতা জনসাধারণের মাঝে সৃষ্টি করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব হওয়া উচিৎ এবং সামাজিক আচার আচরণ মান্য করা এই দু’টি বিষয়কে বাস্তবিক চর্চার মধ্যে আনতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু দরকারি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যেতে পারে:

১. পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা সংযুক্ত রেখে স্ব শিক্ষা ও গুণগত শিক্ষার
হার ও মানের বৃদ্ধি ঘটানো।

২. কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করা।
৩. জনসাধারণের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৪. সামাজিকীকরণের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শিশুকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
করা।
৫. সব ক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তেনের সাথে সাথে অপরাধ দমনে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

৬. রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি বিধান; আচার আচরণ; প্রথা পদ্ধতি; ইতিহাস ঐতিহ্য; ন্যায়
অন্যায়; আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চার সঠিক প্রয়োগ করা।
৭. সামাজিক জীব হিসেবে কোনটি করা উচিৎ আর কোনটি করা উচিৎ না সে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
৮. সামগ্রিক উন্নয়নের নামে মানবিক বোধকে ধ্বংস না করে প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রেখে উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করা।
৯. গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী মুক্তি, মুক্ত চিন্তা, গবেষণা ও বৈশ্বিক জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রকে
প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অবারিত করা।

এসব বিষয় ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে মানব সৃষ্ট দুর্যোগ যেমন কমবে ঠিক তেমনি হ্রাস পাবে পৃথিবীর বুকে আঘাত হানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার। বিশ্ব মাতব্বরের দরবারে এমন একটি পৃথিবী গড়ে তোলার আহবান এসেছে প্রকৃতির নিকট থেকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ বিশ্ব শান্তির জন্য এক জোট হয়ে কাজ করেছিলো।

কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্ব গড়তে সব ধরণের উগ্রতা, দাম্ভিকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, জোর জবরদস্তি, জুলুম, হুমকি, হিংসা, পরশ্রীকাতর, নির্ভরশীলতা, সামাজিক অসমতা ও অসম উন্নয়ন, পারস্পারিক অশ্রদ্ধা বোধ, নিগ্রহ ও পরাধীনতা প্রভৃতি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ কল্যাণকর বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। ভবিষতের এমন একটি বিশ্ব ও দেশে নিশ্চয় সব ধরণের উৎসব আয়োজন নিয়ে ঈদ ও অন্যান্য উৎসব আনন্দ উৎযাপন করতে পারবে বিশ্ব ও দেশবাসী।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক সমাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মুক্ত ধারার এই বিশ্ব বর্তমানে অবরুদ্ধ কোভিড-১৯ এর প্রভাবে। এর প্রভাবে মুসলিম বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোজা ও ঈদুল ফিতরের আয়োজনে এসেছে ভিন্ন রূপ। সামাজিক সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে ইথার তরঙ্গে, বার্তা আদান প্রদানের মধ্যে। সামাজিক নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে দেশ-বিদেশে, বন্ধু-বান্ধব ও আপন পরিজনদের সাথে। কিন্তু সব সময় সামাজিক নেটওয়ার্ক প্রিয় মানুষগুলোকে কাছে পাবার তৃপ্ততার অনুভূতি পূরণ করতে পারে না।

আমাদের দেশে ঈদে আপনজনদের কাছে পাবার আনন্দ অনেক কিছুর আনন্দ প্রাপ্তির সমান। মায়ের সাথে সন্তানের চোখের দেখা ও কাছে পাবার টান কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করার না। পারিবারিক ও সামাজিক অন্যান্য সম্পর্কের জালগুলোর মধ্যে সম্পর্ক তেমনি। এ বছরে অনেকেই পরিবার পরিজন অথবা আপন জনদের ছাড়াই ঈদ আনন্দ সম্পন্ন করতে যাচ্ছে। যদিও দীর্ঘ ছুটিতে অনেকেই নিজ বাড়িতে আপনজনদের সাথে রয়েছে।

আবার অনেকেই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে। যারা প্রবল ইচ্ছে থাকলেও গ্রামের বাড়িতে ঈদ আনন্দে সামিল হতে পারছে না। এই ঈদ যাত্রায় ছোট ছেলে মেয়ে ও ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে দূরের পথে যাত্রা করাও বিপদজনক। অপরদিকে একটু ভেবে দেখুন! ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী, ডিসি, এসপি, ইউএনও, প্রধানমন্ত্রীসহ বিশেষ বিশেষ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীগণ, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা, জরুরী পরিসেবায় খুলে দেয়া মন্ত্রাণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী, পুলিশ সদস্য, সেনাবাহিনী, জরুরী সেবাদান প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীরা, বিদেশের মাটিতে আটকিয়ে থাকা দেশের নাগরিক, পরিচ্ছন্ন কর্মী, কোভিড-১৯ এর ল্যাব পরীক্ষায় নিয়োজিত গবেষক, শিক্ষক ও কর্মীদের পরিবার পরিজন ছাড়া একাকী ঘরে বসে ঈদ উৎযাপন করবে। সেটা অনেক বেশি বেদানাদায়ক।

মনের মাঝে এমন ভাবনা কষ্টকর ও বিষাদময়। জনগণ ও দেশের প্রয়োজনে তাঁরা অনেক কিছুর সুখ আনন্দকে বিসর্জন দিয়েছে এই ঈদ আনন্দে। সাধারণ জনগণের উচিৎ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা ও এসকল জন কল্যাণে নিবেদিত মানুষগুলোকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করা। ঈদ, পূজা, বড় দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বিজু উৎসব এসব সুখ আনন্দের উৎসবসমূহ পূর্ণতা পায় আপনজনদের কাছে পাবার মাধ্যমে। বাঙ্গালির মাঝে আপনজনের মধ্যকার টান হাজার বছরের ঐতিহ্যের নিদর্শন।

আমাদের সমাজে আপনজনদের অনেক দিনের দূরে থাকার পরে প্রাণের কাছাকাছি আসার উপলক্ষ্যই হলো সামাজিক ও ধর্মীয় এই সব অনুষ্ঠানসমূহ। যেমনটি বিশ্ব ও দেশের একটি বড় অংশের নাগরিক তাঁদের পরিবার ও নিকটজনদের কাছে যেতে পারছে না। ঈদ উৎযাপনের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় হয়নি কখনো।

পশ্চিমা বা ইউরোপ-আমেরিকার সমাজ কাঠামোতে এগুলোর প্রচলন খুব কমই দেখা যায়। কারণ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, আধুনিকতা, নগরায়ন, বাণিজ্যিকীকরণ, চরম শ্রম বিভাজন, ভোগবিলাসিতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সেসব দেশের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রক্তের সম্পর্কগুলোকে দুর্বল ভিত্তির ওপরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সে কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ভার্চুয়াল সম্পর্কের ভিতসমূহ সেসব দেশে অনেক শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করতে পেরেছে। যেমন ডে কেয়ার সেন্টার, শিশু কেয়ার, ওল্ড হোম, দাতব্য সংস্থা, মাদার ও ফাদার ডে প্রভৃতি।

পারিবারিক ও সামাজিক আবহের মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠা মানুষের মধ্যকার সম্পর্কগুলো হৃদয়স্পর্শী হয়। এসব সম্পর্কগুলো নাড়া দেয় মানুষের গভীরের মনকে। মন গহীনের শব্দে, তা প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে মানব মনের আঙ্গিনায়। বাংলার ঈদ আনন্দ মানুষের মনকে সেই আনন্দের ঝর্ণা ধারায় ভাসিয়ে তোলে।

কোভিড-১৯ এর বিশ্বময় মহামারীর মধ্যে সে আনন্দ আজ অনেকটাই ফিকে। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে বলছে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ….. আজই পড়বি ঈদের নামাজ রে ভাই ঐ সেই ঈদগাহে।’ কিন্তু কবির সেই আহ্বান মুসলিম বিশ্বে তথা গোটা বিশ্বে এ বছরে দেখা যাচ্ছে না। প্রাকৃতিক এই পৃথিবীকে মানুষ বিজ্ঞান ও তাঁর জ্ঞান দিয়ে অনৈতিকভাবে শাসন করেছে বছরের পর বছর। যত্রতত্র ব্যাপক হারে শিল্পায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণ তার অন্যতম প্রধান কারণ। এর প্রতিক্রিয়া বিশ্ব তার ওপর বসবাসরত প্রাণীকুল ও মানব জাতির ওপর নির্দয়ভাবে নিচ্ছে।

প্রকৃতির ভারসাম্য আনতে পৃথিবী বর্তমানে লকডাউনে রয়েছে। আমূল সংস্কারের কাজ চালাচ্ছে পৃথিবী। প্রাণীকুল ও প্রকৃতি বর্তমানে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। সাগর উপকূলে ডলফিনের অবাধ বিচরণ অথবা হাজার হাজার কচ্ছপের সাগরতীরে ডিম পাড়ার দৃশ্য প্রভৃতি এসবেরই উদাহরণ। নিশ্চয় আল্লাহের অশেষ নিয়ামতের এই পৃথিবী আমাদের জন্য বাসযোগ্য সুন্দর আবাসস্থল ফিরিয়ে দিবে। সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট, বিশ্বের সৃষ্টির রহস্য মানব জাতির নিকট নিদর্শন রূপে তুলে ধরেন। যাতে তাঁরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।

বিশ্বব্যাপী ২০২০ সালের ঈদের এমন উৎযাপন আমাদের সে শিক্ষাই দেয়। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে ন্যয়-নীতি, আদর্শ, নৈতিক, যৌক্তিক, আশাবাদী, বাসযোগ্য ও মানবিক বোধের নতুন পৃথিবীর প্রত্যাশা বিশ্ব উম্মার।


লেখকঃ চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সম্পাদক বাংলাদেশ স্কাউটস গোপালগঞ্জ জেলা রোভার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *