ঐস্বর্গীক বগুড়ার, নৈস্বর্গীক সৌন্দর্য

ঐস্বর্গীক বগুড়ার, নৈস্বর্গীক সৌন্দর্য

ইসরাত জাহান ইতি


বগুড়া বুক চিরে বয়ে চলা করতোয়ার কলকল শব্দে মুখরিত বগুড়ার আকাশ বাতাশ। কোকিলের কুহু কুহু শব্দে মুখরিত কাঞ্চকানন। সোনালী রোদের আভায় চিক চিক করে পুণ্ড্রনগর যা একসময় ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী।

প্রাচীন বগুড়া শহরটি করতোয়া নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত । নদীটি উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বগুড়াকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। বগুড়ার উত্তরে গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট জেলা, দক্ষিনে সিরাজগঞ্জ জেলা, পুর্বে যমুনা নদী এবং পশ্চিমে নওগাঁ জেলা।

অপূর্ব এ্ই বগুড়াকে উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বলা হয়। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বগুড়া জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।

১৮২১ সালে এটি জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর আয়তন: ২৮৯৫.০১ বর্গ কিমি এবং মোট উপজেলা ১২ টি। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে এক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ গড়ে উঠেছিল এই বগুড়া জেলাতেই। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই বগুড়া জেলা বাংলার প্রাচীনতম একটি শহর ।

ভারতের রাজা “আশকা” বাংলা জয় করার পর এর নাম রাখেন পুণ্ড্রবর্ধন । প্রাচীন পুন্ড্র রাজ্যের রাজধানী পুন্ড্রবর্ধনই হচ্ছে এ বগুড়া জেলা যার বর্তমান নাম মহাস্থানগড়। আবার অনেকের মতে, বগুড়ার প্রাচীন নাম বরেন্দ্রভূমি ও পৌণ্ড্রবর্ধন। আজকের রাজশাহীও এই অঞ্চলভুক্ত ছিল। অঞ্চলটি ৯ থেকে ১২ শতক সেন রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়। পরে ১৩শ শতকের শুরুতে তা মুসলিম শাসকদের অধীনে আসে।

পৌরাণিক এবং প্রাচীনকালের ইতিহাসে বগুড়া দখল করে আছে নান্দনিক বৈচিত্র্য । চমৎকার কারুকাজখচিত মিনার, গম্বুজ, নকশা ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনিতে এখানকার স্থাপনাগুলো অত্যন্ত চমৎকার । ঐতিহাসিকদের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকে বগুড়া মৌর্য শাসনের অধীনে ছিল। মৌর্য এর পরে এ অঞ্চলে চলে আসে গুপ্তযুগ ।

এরপর শশাংক, হর্ষবর্ধন, যশোবর্ধন পাল, মদন ও সেনরাজ বংশ । মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন প্রভৃতি রাজাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল এই প্রাচীন জনপদ বগুড়া । ১২৭৯ – ১২৮২ পর্যন্ত এই বগুড়া অঞ্চলের শাসক ছিলেন সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের পুত্র সুলতান নাসির উদ্দিন । তার নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম হয়েছিল বগড়া ।

ইংরেজি উচ্চারন ‘বগড়া’ (English: Bogra) হলেও বাংলায় কালের বিবতর্নে নামটি পরিবর্তিত হয়ে ‘বগুড়া’ শব্দে পরিচিতি পেয়েছে। ২ এপ্রিল ২০১৮ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকে বগুড়ার ইংরেজি নাম Bogura করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বিখ্যাত “মহাস্থানগড়” যা বগুড়া শহরে থেকে ১১ কিঃমিঃ উত্তরে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সবার কাছেই একটি পবিত্র স্থান। এখানে মাজার জিয়ারত করতে এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন বহু লোক সমাগম ঘটে।

এছাড়াও আছে বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের বাসর ঘর, গোকুল মেধ, বসু বিহার, যোগীর ভবণ,‍‍‌ বিহার, ভিমের জঙ্গল, খেরুয়া মসজিদ, বড় মসজিদ, শাহ সুলতান বলখীর মাযার, পাঁচপীর মাযার, পরশুরামের প্রাসাদ, পল্লী-উন্নয়ন একাডেমী, সাউদিয়া পার্কসিটি, কারুপল্লী, ওয়ান্ডারল্যান্ড শিশুপার্ক, শাহনেওয়াজ শিশুবাগান, উডবার্ন পার্ক, দৃষ্টিনন্দন পার্ক, বিজয়াঙ্গন ও শহীদ চান্দু নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে। বগুড়া শহরে রয়েছে “নওয়াব প্যালেস” যা ব্রিটিশ আমলে “নীলকুঠী” নামে পরিচিত ছিল । এখানে থাকার জন্য রয়েছে চার তারকা বিশিষ্ট “নাজ গার্ডেন” ।

করতোয়া স্রত জেলা ভূমিতে জম্মগ্রহণ করেছেন প্রোথিতযশা অনেক কবি সাহিত্যিক । তাঁদের রচনা কর্মে একদিকে যেমন এ জেলার গৌরবময় ভূমিকাকে উজ্জল করেছে, তেমনি এদেশের সাহিত্যিাঙ্গনকে করেছে গতিশীল ও সমৃদ্ধ। এ জেলার প্রাচীন কালের কবি সাহিত্যিকদের রচনাবলী দ্বারা আমরা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বার বার ফিরে পাই। লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নের কবি জীবনকৃঞ্চ মৈত্র। তিনি বাংলা সাহিত্যির ইতিহাসে মনসা মঙ্গলের কবি হিসাবে পরিচিত।

জীবন কৃঞ্চ মৈত্রের কাব্যেবের নাম ‘‘ পদ্ম পুরন’’, এতে চাঁদসওদাগর মনসা, বেহুলা লক্ষিদরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ডাঃ কহরউল্লাহ এর লেখা ‘‘মহাস্থান’’ নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস থেকে মহাস্থানগড়ের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞ্যাত হওয়া যায়। তাছাড়া এ উপজেলায় তদানিনত্মন পাকিসত্মানের প্রধানমন্ত্রী জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ আলী চৌধূরী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক রোমেনা আফাজ, এম.আর আকতার মুকুল, বি.এম ইলিয়াস, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জেড ফোর্সের প্রধান মেজর (অবঃ) জিয়াউর রহমান, পলস্নী কবি রোসত্মম আলী কর্ণপুরী, কণ্ঠশিল্পি আঞ্জুমান আরা এবং রাষ্ট্রপতির শিল্পউদ্যোক্তা পুরস্কারপ্রাপ্ত ওয়ান ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেশের অন্যতম সিআইপি কৃষিবিদ কে.এস.এম মোস্তাফিজুর রহমান জম্ম গ্রহণ করেছেন।

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলা একটি শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর। এখানে বিসিকসহ ছোট ও মাঝারি ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশের একমাত্র ফাউন্ড্রি শিল্পখ্যাত এই বগুড়া জেলায়। ফাউন্ড্রি শিল্পের পাশাপাশি বর্জ্য তুলা, ঝুট কাপড়, বেডসীট মশারী কাপড়, সাবান, জুট মিলস, পেপার মিলস, ফিড মিলস, সিমেন্ট কারখানা, পোল্ট্রিশিল্প সহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এখানে গড়ে উঠেছে। এ সব শিল্প প্রতিষ্ঠান হতে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন হয়। যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, কানাডা সহ বিভিন্ন দেশে রপ্তান্তি বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইহা শিল্পের শহর নামে পরিচিত।

উপজেলাটি খাদ্য শস্য ও শাকসবজি উৎপাদনের ভান্ডার হিসেবেও বেশ খ্যাত। এখানকার মরিচ ও দই খুবই বিখ্যাত। বগুড়ার দই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত বগুড়া জেলার বিখ্যাত মিষ্টি। কথিত আছে, ষাটের দশকের প্রথম ভাগে বৃটেনের রানী এলিজাবেথ থেকে মার্কিন মুল্লুকেও গিয়েছিল এই বগুড়ার দই।

পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তাদের সহানুভূতি পেতে পাঠিয়েছিলেন এই বগুড়ার বিখ্যাত দই। আবার এখানকার মাটি বেশ উর্বর হওয়ায় প্রচুর শস্য উৎপাদন হয় । বিগত কয়েক বছরে বগুড়ায় লাল মরিচের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা কিনা ১০০ কোটি টাকার ব্যবসায় পরিণত হয়েছে । সাম্প্রতিক সময়ে বগুড়া শহরের প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নতি সাধিত হয়েছে । উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত বগুড়া সদর উপজেলার উপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে বিশ্বরোড নামক প্রশসত্ম সড়ক।

বাঙালি সংস্কৃতি বলতে সাধারণত বোঝানো হয় বিশেষ সমাজের সাহিত্য, সংগীত, ললিত কলা, ক্রিড়া, মানবিকতা, জ্ঞানের উৎকর্ষ ও আরো অনেক শান্তি ও সৌন্দর্যের সমাহার। আঞ্চলিক সংস্কৃতি বলতেই আমরা বাঙালি সংস্কৃতি বুঝি । প্রতিটি আঞ্চলের নিজস্ব কিছু ভাষা ও সংস্কৃতি থাকে । তেমনি সুফি, মারাঠি, লালন ইত্যাদি নিয়ে বগুড়ার সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ।

তাছাড়া জারিগান, মারফতি, ভাটিয়ালি, কবি গান, কীর্তন, যাত্রাপালা, মেয়েলি গীত, প্রবাদ, প্রবচন, ধাঁধাঁ ইত্যাদি বেশ উল্লেখযোগ্য । শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বগুড়ার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। সাংস্কৃতিক কর্মীদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বলয়। মানুষ প্রকৃতির সন্তান । সজীব প্রকৃতি মানে শুধু বৃক্ষ বা অরণ্য নয়। আমরা মানুষেরাও এই প্রকৃতির অংশ । এ জেলার প্রকৃতি অপরুপ সাজে সজ্জিত । মানুষগুলো প্রকৃতির মতোই সহজ সরল ও সংস্কৃতিমনা ।

ভ্রমণপিপাসুদের আগমনে এখানকার প্রকৃতি মুখরিত হয়ে ওঠে । এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য যেনো ছবির মতো পটে আঁকা। শিল্পের রংতুলিতে আঁকা যেন এখানকার গ্রামীন মেঠো পথগুলো । প্রকৃতি যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে! কী রোদ কী বৃষ্টি, সকল বাঁধা উপেক্ষা করেই ভ্রমণপিপাসুরা সারা দিচ্ছে তার ডাকে ।

লেখকঃ তরুণ নারী উদ্যোক্তা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *