কন্যা-দিবসে-এক বাবার অনুভূতি

কন্যা-দিবসে-এক বাবার অনুভূতি

ড.মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন

সময়টা ১১ জুন, ২০০৬। ফজরের সময়… গর্ভস্থ সন্তান নড়ছে না… ভয়ে অস্থির। সিংগাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ভর্তি… দুপুর ২ঃ৪৫ মিনিটে আমার স্টাটাস চিরতরে পরিবর্তন হয়ে গেল… কন্যা সন্তানের বাবা হলাম। তখন ঝিরেঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল… পৃথিবীতে এসেই ফাতিমা বড় করে তাকাল… ইণ্ডিয়ান গাইনোকলজিস্ট ডা,আন্নাপুন্না দুষ্টুমি করলেন… দেখো, দেখো, পৃথিবীতে এসেই বাবার দিকে তাকাচ্ছে মেয়ে।

দৌড়াদৌড়ির জন্য বাবা’র অনুভূতি তেমন কাজ করল না, যদিও ওর জন্মের আগ থেকে ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে কল্পনায় মেয়ের সাথে গল্প করতে কখন জানি বাসায় পৌছে যেতাম। সে গল্প আজ ধ্রুব সত্য হয়েই আমার চোখের প্রশান্তি৷

জন্মের একদিন পর ডাক্তার জানালো ফাতিমার জন্ডিস হয়েছে। ফটো-থ্যারাপী দিতে হবে কয়েকদিন। পরামর্শ দিল ওকে একা তাদের তত্ত্বাবধানে রেখে বাসায় চলে যেতে। ওকে ছাড়া দুজনে বাসায় ফেরার সময় শুণ্যতা অনুভব করতে লাগলাম। সকাল-বিকাল মেয়েকে দূর থেকে দেখতাম। অবশেষে ফাতিমাকে কোলে নিয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম। দুজন থেকে হয়ে গেলাম তিনজন…

নতুন বাবা-মা, পরামর্শ নেয়ার মত কেউ পাশে নেই। দেখা গেল ও খাচ্ছে না… টয়লেট করছে না সপ্তাহখানিক ধরে… টেনশনে অস্থির… ল্যাব থেকে মাঝে মাঝে খবর নেয়া… অনলাইনে পড়াশুনা করে নতুন মা-বাবা হিসেবে ভয় দূর করতাম, আশ্বস্ত হতাম যে মেয়ের তেমন কিছু হয়নি… এসব মাতা-পিতার হওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

মেয়ে তো হাঁটছে না… না হাঁটার কারন কী-এসব নিয়েও পড়াশুনা করতাম… এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে কাপড় শুকানোর লাঠি দিয়ে প্র্যাক্টিশ করাতাম… খুব স্বাভাবিক, কিন্তু কেন জানি একা হাঁটতে ভয় পায়। এশার সালাত আদায় করছিলাম… ফাতিমা পাশে বসে খেলছিল… সালাতের মাঝে দেখলাম ও হেঁটে সামনে দিয়ে চলে গেল! সে কোন অবলম্বন ছাড়া দাড়ায়নি কখনো। সেই রাতেই মেয়ে সারা বাসা দৌড়ে কাটালো! ওকে শুধু আমরা উৎসাহ দিলাম তাতে খুব এক্সসাইটেড হয়ে দৌড়ালো ৩০ মিনিটের মধ্যে।

হাঁটা শেখার পর ওর মা মেয়েকে প্রতিদিন পার্কে নিয়ে যেত.। বিড়াল দেখতে খুব আগ্রহ ছিল ফাতিমার… ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে ডোভার কমিউনিটির সেই পার্কের ওভারব্রিজ দিয়ে নামতেই মেয়ে দৌড়িয়ে, লাফ দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরত… সে এক অন্য অনুভূতি। তারপর আমরা তিনজনে বাসায় ফিরতাম একসাথে…।

গুছিয়ে কথা বলা শিখল… নতুন নতুন গল্প বলার চেষ্টা করত… আমি টুনাটুনির গল্পটি কতভাবে রং-চং দিয়ে বিভিন্ন এংগেলে শুনাতাম… চুড়ুই পাখী ওকে প্রায়ই আকাশে বেড়াতে নিয়ে যেত… সিংহ-ইদুরের গল্প সহ কত কি…গল্প বিকৃতি করে নিজের মত করে বলতে ওস্তাদ ছিলাম আমি৷

মেয়ে এখন বড় হয়ে গেছে। জীবনের আরেকটি ক্রিটিক্যাল ধাপ পার করছে…
আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে হয়ত ১০ বছরের মধ্যে নিজেই নতুন সংসার শুরু করবে ইনশাল্লাহ। একসময় সন্তানের মা হয়ে যাবে সেই ছোট্ট মেয়েটি। এটিই জীবনের পরিক্রমা যার মধ্যে দিয়ে সবাইকে যেতে হয়।

রিসার্চকে কমিউনিটি সার্ভিস হিসেবে ধারন করার কারনে আগের মত সময় পাই না… ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে মেয়ের সাথে।ওর মা’কে প্রায়ই বলি -যে ইফোর্ট দেয়ার সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন তার কারনে বাবার জন্য সন্তানের একসময় অন্যধরনের ভালবাসা তৈরী হবে। বড় হলে ওরা একদিন ঠিকই বুঝবে, . বাবা’কে অন্যভাবে আবিষ্কার করবে ইনশাল্লাহ।

ফাতিমার মাকে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়… দেখবে, ফাতিমা মাতৃত্ব লাভের ক্রিটিক্যাল সময়ে ওর পাশে থাকব যদি আল্লাহ ততদিন বাঁচিয়ে রাখেন…, নানাভাই হিসেবে গ্রেট হবো!

পরিবারের বড় সন্তান, কন্যা সন্তানের বাবা হওয়া সত্যিই আল্লাহর বিশেষ রহমত… কন্যা সন্তানরা মূলত শেষ বয়সের বাবা-মা’র মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে। ছেলে সন্তানগুলো সাধারনত বাবা-মা’র কাছে অধরা হয়ে যায়…

লেখক
ড.মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন
সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ
ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি।
নির্বাহী পরিচালক,
বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউণ্ডেশন, বাংলাদেশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *