করোনা মোকাবেলায় কি করবেন আর কি করবেন না?: প্রফেসর ড. আবুল হোসেন

করোনা মোকাবেলায় কি করবেন আর কি করবেন না?: প্রফেসর ড. আবুল হোসেন

প্রফেসর ডঃ মোঃ আবুল হোসেন


করোনা ভাইরাস আক্রমণের মহাবিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য নিম্নোল্লিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করুন (দেশ-বিদেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও স্ববিবেচনা থেকে সংকলিত)।

করোনার বিস্তার, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও মৃত ব্যক্তির দাফন বিষয়সহ বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন এবং-প্রচার করুন।

১। করোনা ভাইরাসের ভয়ঙ্কর বিস্তার লাভ যেভাবে হচ্ছেঃ-

(ক) ভাইরাসটি নিত্য নতুন জাত পরিবর্তনে সক্ষম বিধায় ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তাই উন্নত রাষ্ট্রও তাদের লাশের স্তূপে থমকে গেছে।

(খ) আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি (ছয় ফুটের মধ্যে থাকলে), নাকের পানি, সর্দি, থুতুর সংস্পর্শে আসলেই আক্রান্ত হতে পারেন।

(গ) ভাইরাসটি কাগজ ও টিসু পেপারে ত্রিশ মিনিট, কাপড়চোপড়ে চব্বিশ ঘণ্টা, স্টেইনলেস স্টিলের উপর চার দিন, সার্জিক্যাল মাস্কে সাত দিন, কোন কোন বস্তুর উপর দশ দিন পর্যন্ত এবং ফ্রিজের জিনিসে প্রায় দুই সপ্তাহ নির্জীবের মত থাকতে পারে এবং উল্লেখিত সময়ের মধ্যে এসব স্থান থেকে মানব দেহে প্রবেশের পর কর্মক্ষম হয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে।

(ঘ) একারণেই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, সর্দি, থুথুর মাধ্যমে ভাইরাসটি গণপরিবহন যথা- রিকসা, বাস, ট্রেন ইত্যাদির সুইচ, হাতল, দরজা, জানালা, টয়লেট, দেয়ালের সাথে লাগতে পারে এবং এসবের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারে।

(ঙ) একই কারণে এ ভাইরাস বাজারের মালামাল, শরীরের কাপড়চোপড়, মাছ মাংস, সবজি, ফলমূল, ইত্যাদিতে লাগতে পারে এবং এসবের স্পর্শে আসা হাতের মাধ্যমে আপনার নিকটজনও আক্রান্ত হতে পারে।

২। নিম্নরূপে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলুনঃ-

(ক) ভাইরাসটি ঘনঘন জাত পরিবর্তনে সক্ষম বিধায় প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন/ঔষধ আবিষ্কার কঠিন হয়ে পড়েছে, একমাত্র আল্লাহ তাআলার রহমতেই এর বিস্তার রোধ হতে পারে
তাই সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে মুক্ত হয়ে যার যার ধর্ম মোতাবেক কায়মনোবাক্যে আল্লাহ/ সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন, মুসলিমগণ তওবা পড়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও সাহায্যের জন্য দোয়া করুন।

উন্নত দেশগুলো (যেমন ইতালি) এ ভাইরাস প্রতিরোধে সকল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শেষে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য আশা করছে।

(খ) লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা মেনে চলুন, সরকারি-বেসরকারি প্রচারণা ও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলুন ।

অযথা একাধিক ব্যক্তি একত্র হবেন না, কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলুন, ফেস মাস্ক ব্যবহার বা পরিষ্কার কাপড়, শাড়ির আঁচল, ওড়না, রুমাল অথবা গামছা দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে চলুন।

অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাজার বা গণজমায়েতে যাবেন না, বয়স্ক লোকজনকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বাড়িতেই রাখুন।

জরুরী দীর্ঘ যাত্রাকালে সময় সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হেক্সিসল ব্যবহার করুন।

(গ) বাইরে থেকে আবাসস্থলে অথবা বাড়ীতে পৌঁছার সাথে সাথে অন্য কোনো কিছু স্পর্শ করার পূর্বেই আপনার হাতদুটো সাবান বা লিকুইড হ্যান্ড ওয়াশ দ্বারা ভালো করে ধুয়ে নিন, তারপর নাক মুখের ভেতরসহ মুখমন্ডল পরিষ্কার করুন।

গায়ের পোশাক পরিবর্তন করে ধোয়ার ব্যবস্থা করুন, সম্ভব না হলে কড়া রৌদ্রে কয়েক-ঘন্টা ওলটপালট করে শুকিয়ে নিন ।

বাজার থেকে আনা কাঁচামাল যথা লাউ কুমড়া, শাক সবজি, শসা, কলা, শিম, বেগুন, মরিচ ইত্যাদি ব্যাগসহ কয়েকবার ধুয়ে হালকা রোদে বা বাতাসে শুকিয়ে নিন। নচেৎ এসব তরকারি কাটার সময় তা থেকে আপনি আক্রান্ত হতে পারেন, মাছ মাংস দ্রুত ধুয়ে রাখুন।

বাজার থেকে আনা শুকনা দ্রব্যাদি পৃথক ঘরে বা পৃথক স্থানে কমপক্ষে ১০-১২ ঘন্টা রাখার পর ব্যবহার করুন ।

কমপক্ষে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খাদ্যদ্রব্য গরম করে খাবেন ।

বাসা/অফিস/গণপরিবহনের চাবি, সুইচ,হাতল, দরজা,সীট ইত্যাদি পরিষ্কার রাখুন এবং ১ঃ৪৯ অনুপাতে সাবান-পানি, ব্লিচিং সলিউশন বা ৭০ % ইথানল দ্বারা মাঝেমধ্যেই মুছে রাখুন।

বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন, বাথরুম ব্যবহারের পর সাবান-পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিবেন বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দ্বারা জীবাণুমুক্ত রাখুন ।

রোগীর কাপড় চোপড়, বালিশ বিছানার কভার ইত্যাদি ফুটন্ত পানিতে ধূয়ে নিন, অন্যদের গুলোও নিয়মিত পরিষ্কার করুন।

(ঘ) শারীরিক ইমিউনিটি মজবুত করার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে শক্ত থাকুন, উপরোল্লিখিত কাজগুলো করুন, না পারলে ব্যায়াম করুন। মনে রাখবেন পরিশ্রমই আপনার শরীরকে ভাইরাস প্রতিরোধী করতে পারে ।

ইমিউনিটির জন্য রোগীসহ সকলেই লেবুর তিন-চারটে পাতলা টুকরা ঘুটে নিয়ে উষ্ণ লেবু পানি পান করুন, পাশাপাশি সারাদিন ঘন ঘন প্রচুর হালকা উষ্ণ পানি বা নরমাল পানি পান করুন, প্রচুর ভিটামিন সি যুক্ত টক জাতীয় ফল খাবেন, সম্ভব হলে মাল্টিভিটামিন খাবেন।

করোনাভাইরাস গলায় তিন-চারদিন ইনকিউবেশনের থাকে, তারপর শ্বাসনালীতে ও ফুসফুসে যায়। তাই বাইরে থেকে বাড়িতে আসার পর পরই এবং বাড়িতে থেকেও সারাদিন কমপক্ষে ২-৩ বার উষ্ণ লবণ-পানি বা নরমাল পানি দ্বারা গড়গড়া করুন।

ইসলাম ধর্ম মোতাবেক মাঝেমধ্যেই মধু ও কালোজিরা খাবেন ।

(ঙ) এসময় দোকানে পান সুপারি, চা-কফি (মেশিন-মেড ছাড়া) খাবেন না। কারণ একই পাত্রের দূষিত পানিতে এসব ধৌত করা হয়। কেবল বাড়িতে পান সুপারি ভালো করে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে খেতে পারেন।

অন্যজনের মুখে দেয়া বিড়ি, সিগারেট, রুমাল, গামছা, টাওয়েল ইত্যাদি ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না, এ সুযোগে এসব বদ অভ্যাস ত্যাগ করুন।

খাদ্যদ্রব্য অযথা মজুদ করবেন না, মনে রাখবেন বেচাকেনা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকবে না। তাছাড়া এসব করতে যেয়ে সবাই মারা গেলে আপনার মজুদ দ্রব্যাদি কে খাবে? একইভাবে দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফাখোরেরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার অর্থই বা কে ভোগ করবে?

(চ) যারা বাইরে চাকরি বা ব্যবসার সাথে যুক্ত আছেন তারা ঘরে ফিরেই অন্য কারো দ্বারা দরজা খোলা ও বন্ধ করাবেন, হাত সাবান দিয়ে ধোয়ার পর ব্যাগ পোশাক ইত্যাদি সরিয়ে রেখে পুনরায় হাত মুখ ধুয়ে নিন ।

ঘরের সংখ্যা কম থাকলে একই কক্ষে কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করুন, টাকা-পয়সা মানিব্যাগ অফিস ব্যাগ ব্যবহারের সাথে সাথেই পুনরায় হাতমুখ ধুয়ে নেবেন।

বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিবর্গ একইভাবে বাড়িতে অতি সাবধানে দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করবেন (সম্ভব হলে পৃথক ঘরে), ১৪ দিনের মধ্যে অসুখের উপসর্গ দেখা না গেলে তারা আক্রান্ত নন প্রমাণিত হলেও পরবর্তীতে তারা এখানে থেকেও আক্রান্ত হতে পারেন।

৩। চিকিৎসা ব্যবস্থাঃ-

(ক) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরে জ্বর, মাথাব্যাথা, গলা-ব্যাথা, নাক দিয়ে পানি ঝরা, গা চাবানি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যেতে পারে এবং আক্রমণের সাত দিনের মাথায় এসব কমে যেতে পারে ও সর্দি ঘন হতে পারে, যদি তা হয় তবে বুঝতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অন্য কোন সমস্যা না হলে চিকিৎসকের প্রয়োজন হবে না।

প্রকৃতপক্ষে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়া ভাইরাস রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, তবে শরীর ব্যাথা, জ্বর ইত্যাদিসহ সেকেন্ডারি ইনফেকশন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তাই পূর্বে উল্লেখিত উপসর্গ দেখা গেলে এবং চিকিৎসক না পাওয়া গেলে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে দিনে ৩/৪ টি প্যারাসিটামল খাওয়ার পর খাবেন, হাঁচি-কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়লে অ্যান্টিহিস্টামিন যথা- এলাট্রল বা ফেক্সো দিনে একটি করে ট্যাবলেট খাবেন।

ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলুন, উষ্ণ পানি ব্যবহার করুন, ঘনঘন লবণপানি দিয়ে গড়গড়া করুন, প্রচুর লেবু পানি বা নরমাল পানি পান করুন।

(খ) এসবের পরেও যদি আপনার জ্বর, শরীর ব্যাথা , মাথা ব্যাথা না কমে বা ঠান্ডা নিউমোনিয়ার মতো বা চেস্ট ইনফেকশন এর মত মনে হয় সেক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন বা নিকটবর্তী চিকিৎসা কেন্দ্রে যাবেন ।

যে কারণেই হোক, আক্রান্ত হলে নিজের হাঁচি-কাশি, সর্দি , থুথু ইত্যাদি যেন কোথাও না লাগে, তাই রোগীকে অবশ্যই পরিষ্কার ফেস মাস্ক বা পরিষ্কার রুমাল , গামছা , টাওয়েল , ওড়না , শাড়ির আঁচল ইত্যাদি ব্যবহার করার পর সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।

এভাবে নিজে ভাল থাকুন, দেশ ও জনগণকে বাঁচতে দিন, আল্লাহ আপনার সহায় হবেন।

৪। মৃত ব্যক্তির সৎকার/ দাফন প্রক্রিয়াঃ-

আল্লাহ না করুন , করোনায় কেউ মারা গেলে তার নিকট থেকে দূরে থাকুন , দ্রুত দাফন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি নিন- যেমন কবর খনন , বাঁশ , পলিথিন বা চাটাই ইত্যাদির ব্যবস্থা সহ মৃতদেহকে গোসলের জন্য বিশেষ করে গ্রামের বাড়ির নির্ধারিত জায়গায় এমনভাবে বড় গর্ত করুন যেন বাতিলযোগ্য কাপড় ও ময়লা পানি তার মধ্যে পুতে ফেলা যায়। পুর্ব থেকেই বেশি পানির ব্যবস্থা রাখুন ।

পূর্ব থেকেই মৃতদেহ বহনের খাটিয়ার ভিতর পলিথিন বিছিয়ে বা অন্য কোন ব্যবস্থা এমন ভাবে করবেন যেন মৃতদেহের কোন জলীয় পদার্থ বাইরে না পড়ে ।

চার পাঁচজন যুবক ও শক্ত মধ্যবয়সী ব্যক্তিবর্গের , যারা মৃতদেহ ধোয়া , কাফন পড়ানো ও কবরে নামানোর দায়িত্ব পালন করবেন, অজু অবস্থায় তাদের শরীর পলিথিন বা পরিষ্কার কাপড় দ্বারা মুড়িয়ে নিন, চোখে চশমা ও নাক-মুখ মাস্ক বা কাপড় দ্বারা ঢেকে নিন, সম্ভব হলে হ্যান্ড গ্লাভস পড়ুন।

এ অবস্থায় তারা মৃত দেহকে গোসল করিয়ে, কাফন পড়িয়ে , নতুন কাফন না থাকলে বাড়ির পরিষ্কার কাপড়কে কাফন বানিয়ে জানাযার ব্যবস্থা করবেন , তারপর মৃতদেহ কে কবরে শুইয়ে দিয়ে খাটিয়াটি নিয়ে গোসলের স্থানে রেখে শরীরের পলিথিন , কাপড় ইত্যাদি নষ্ট করতে চাইলে গর্তে ফেলে দিন , খাটিয়াটি সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে দিন।

অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গর্তে ফেলুন , অন্যান্য দ্রব্যাদি সাবান দিয়ে ধুয়ে তারপর গর্ত ভরাট করে গোসলে যাবেন।

এ সময় অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ দাফন প্রক্রিয়া শেষ করে কোন গল্পগুজব না করে দ্রুত নিজ নিজ বাড়িতে গিয়ে পূর্ববর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করবেন।

মনে রাখবেন এ দুর্যোগের সময় গণজমায়েতের সুযোগ নেই, দূরের আত্মীয়-স্বজনকে না আসতে বলে দোয়া করতে বলবেন, তাদের আসার জন্য দেরি করবেন না, পাড়া-প্রতিবেশী দ্বারা দাফন সম্পন্ন করুন।

আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। আমীন।



লেখকঃ প্রফেসর ড. মোঃ আবুল হোসেন, আহবায়ক, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন সহায়ক সংগঠন, শিবগঞ্জ, বগুড়া এবং প্রফেসর (চুক্তিভিত্তিক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি), গোপালগঞ্জ। (ভূতপূর্ব প্রফেসর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ)।



সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *