কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মালিকেরা!

কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মালিকেরা!

মাহবুব হাসান রিপন


১. ছবিগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম! গ্রামের এই মানুষগুলোর শরীরের মাটির গন্ধটি ঢাকার চার দেয়ালের আবদ্ধ ঘরটি থেকে অনুভব করতে পারছিলাম। এই মানুষগুলোর সাথে একটু হেঁসে কথা বললে দ্বিগুণ প্রাণবন্ত সহজসরল হাঁসি যেন ফেরত দিতে প্রস্তুত হয়ে আছে! ছবি’র দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না!

বার বার এই মানুষগুলোর চোখের দিকে চোখ যাচ্ছিলো! কতটা নিরুপায় তাঁরা! কতটা আতংক, ভয়, অপমান সবকিছু পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিলো! অপমানে জর্জরিত মানুষগুলোর খুব কষ্টে চোখের পানি ধরে রেখেছেন! একটি বয়সের পর কাঁদতে মানা বোধহয়!

(ভদ্র)মহিলা কি সহজাতভাবে ছবি তুলছিলেন। এই ছবি তিনি তার উর্ধতন কর্মকর্তাকে পাঠাবেন, এই ছবি তিনি তার ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট করবেন, এই ছবি দেখিয়ে তিনি গর্বের সাথে বলবেন, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে, দেখুন প্রজাতন্ত্রের মালিকদের কি বেহালদশা করেছি আমি! আমার হাত থেকে কেউ রক্ষা পায় না, আমি প্রজাতন্ত্রের একজন আত্মনিবেদিত কর্মচারী!!

(ভদ্র)মহিলার বাবা নিশ্চয় ছিলেন। একবারের জন্যও কি তার বাবার ছবিটি চোখে ভেসে উঠলো না, মনে হলো না, আমার বাবার মতই-তো এই মানুষগুলোর বয়স কিংবা তারচেয়েও বেশি! মনে হলো না! একদমই না…..

২. সিনিয়র সিটিজেন। ইউরোপ – আমেরিকার মত দেশগুলোতে এই শব্দটি বেশ প্রচলিত। একজন সিনিয়র সিটিজেনের সাথে আমাদের আচরণ ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত সেটি আমরা খুব ছোটবেলায় পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে পেয়ে থাকি। বড়দের শ্রদ্ধা করবে, ছোটদের স্নেহ করবে এই নৈতিক শিক্ষা বুলি আকারে আমাদের শেখানো হতো।

বড়দের দেখলে সালাম দিবে, হাসিমুখে কথা বলবে, কটু কথা বলবে না, আঘাত দিয়ে কথা বলবে না,এরকম অনেক নৈতিক শিক্ষা আমাদের পরিবারের সদস্য’রা দিয়েছেন।
যদি আমরা পরিবার থেকে এই নৈতিক শিক্ষা না পেয়ে থাকি তখন বিদ্যালয় থেকেও আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি। ঠিক সেই রকম একটি দেশে যখন এই চিত্র দেখি তখন ভীষণ লজ্জিত হই, ভীষণরকম আঘাত পাই!

২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদের দেশের সকল প্রবীণদের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ঘোষণা দেন।

তিনি প্রবীণ ব্যক্তিদের দেশের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাঁদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা এবং খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সমাজ ও রাষ্ট্রে অবদান রাখার জন্য শ্রদ্ধা প্রদর্শনে আমি সমাজের সকল প্রবীণদের দেশের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ঘোষণা করছি।’

মহামান্য রাষ্ট্রপতি’র এই ভাষণে উল্লেখিত প্রবীণদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা এবং খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩’ তে উল্লেখ রয়েছে। যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

কাজেই প্রজাতন্ত্রের কোন কর্মচারী একজন সিনিয়র সিটিজেন-কে জনসম্মুখে এইভাবে কান ধরে রাখার শাস্তি দিতে পারেন না! যা সরাসরি সেই ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা লঙ্ঘনের সামিল!

৩. আমাদের সমাজে ক্ষমতা একটি বিশেষ বস্তু। যার যত ক্ষমতা তার তত মর্যাদা! আমরা নিরীহ গোত্রের যেকোন জীবের উপরে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে ভালোবাসি। ৫ টাকা ভাড়া বেশি কেন চাইবে এই বলে সটাং করে একটি থাপ্পড় বসে দিতে আমরা কুন্ঠিতবোধ করি না! রাস্তার মাঝখানে রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখে এক মহিলা নেত্রীর রিক্সাওয়ালার উপরে চড়াও হওয়ার খবর খুব বেশি পুরাতন নয়! বাবার বয়সী প্রধান শিক্ষককে ছাত্রদের সামনে কান ধরিয়ে রাখার মত কাজও আমরা দেখেছি, লজ্জিত হয়েছি! আজ আবার আমরা লজ্জিত হলাম!

অথচ, দেশের অর্থনীতির লালবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া অর্থ ডাকাতদের আমরা কিচ্ছুটি করতে পারিনা! তাদের জাতির সামনে নাকে খর দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারিনা, এই দেখো হাজার কোটি টাকার মালিকের অবস্থা! আমরা বলতে পারিনা, এই অর্থ চোরদের চিনে রাখুন! এরা দেশ, সমাজ ও জাতির জন্য কলঙ্ক।

৪. এই জাতি নিয়ে আমার কোন প্রত্যাশা নেই। এই জাতির অতিমাত্রায় সচেতন নাগরিকদের মন্তব্য, পুলিশের ডান্ডা এখনো শুরু হয়নি কেন? বাঙ্গালীদের ডাণ্ডার বারি না পড়লে এরা সোজা হবে না! আমরা নিজেরাই বলে দিচ্ছি, তোমরা চুপ কেন! এসো আমাদের মারো! আমরা ভিডিও করবো! আমরা ট্রল করবো! আমরা বলবো টসে জিতে ব্যাটিং করতে মাঠে নেমেছে বাংলার দামাল পুলিশ মামারা! আমরা বলবো, এসো খেলা হবে…!

এভাবে আমাদের আমজনতার উপরে পুলিশি একশন চলবে আর আমরা সেই মজাটি দেখবো! কোয়ারান্টাইন না মানার জন্য পুলিশের এই লাঠি চালানোকে আপনারা বাহবা দিচ্ছেন। এরপর একটি একটি করে ভিডিও শেয়ার দিচ্ছেন। তারা আজ দিনমজুর দেখছে না, বৃদ্ধ – বৃদ্ধা দেখছেন না যাকে পাচ্ছেন তাকেই বেধড়ক দিচ্ছেন!

রাষ্ট্রের কোন আইনে অসহায়, নিরস্ত্র মানুষদের উপরে পুলিশরে লাঠিচার্জ করার অনুমতি দেওয়া আছে? আমি আমাদের সুশীল আমজনতার কাছে জানতে চাই?
এই রাষ্ট্রের মালিক পুলিশ মামা’রা নয়, এই রাষ্ট্রের মালিক আমলা চাচা’রা নয়, এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। সেই জনগণের জন্য পুলিশ মামাদের চাকুরী দেওয়া হয়েছে।

সেই মালিক জনগণের উপরে পুলিশ মামা ও আমলা চাচা’রা জুলুম করতে পারে না! এই অধিকার তাদের নেই! হুশিয়ার! আপনারা শো ধরে যান, নইলে আমরা শো ধরে দিবো!


লেখকঃ মাহবুব হাসান রিপন, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরকারি তিতুমীর কলেজ বিতর্ক ক্লাব।



প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। দ্য ক্যাম্পাস টুডে এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য দ্য ক্যাম্পাস টুডে কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।



সংবাদটি শেয়ার করুন
fb-share-icon
Tweet

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *