কিরে তকিব, গেলে কই? পাঠক এসে ফিরে যায়!

কিরে তকিব, গেলে কই? পাঠক এসে ফিরে যায়!

গত কয়েক বছরে বাংলা সাহিত্যে অল্প সময়েই পাঠকপ্রিয়তা লাভ করা তরুণ লেখকদের যারা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় তাদের মধ্যে অন্যতম এবং প্রথম সারির লেখক হচ্ছেন তকিব তৌফিক । অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন এই কথাসাহিত্যিকের পঞ্চম বই হিসেবে প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাকটাস’, লেখক হিসেবে তার প্রথম বইমেলার গল্প সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্যা ক্যাম্পাস টুডের সাহিত্য সম্পাদক সোয়াদুজ্জামান সোয়াদ

কেমন আছেন?

আল’হামদুলিল্লাহ্, এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে জীবন ময়দানে বেশ ভালোভাবেই লড়ে যাচ্ছি। ভালো আছি।

ঘরবন্দী সময়টা কিভাবে কাটছে?

এখন তো আসলে ঘরবন্দী সময় কাটাতে হচ্ছে না। কাজের প্রয়োজনে নিয়ম করেই বেরুচ্ছি, বাসায় ফিরছি। তবে কাজের জায়গা বাদে অন্যান্য জায়গায় এখনো সেভাবে যাওয়া আসা হচ্ছে না। আর যখন ঘরবন্দী ছিলাম তখন সময়টাকে বেশ কাজে লাগিয়েছি। পুরোটা সময় লেখা এবং বই পড়াতে দিয়েছি। এটা জরুরি ছিল।

শুনলাম আপনার প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাকটাস’ শীঘ্রই আসছে?

‘ক্যাকটাস’ নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে। যারা আমাকে ফলো করে, আমার সাথে কানেক্টেড তারা আগে থেকেই জানতো যে আমি একটি কবিতার বই নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু বরাবরই কবিতার বই প্রকাশ হওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমার দেরি হয়েছে। কারণ লেখালেখির মধ্যে আমি কবিতার কাজকে বড্ড জটিল ভাবি। গল্প, উপন্যাস আমার জন্য যতটা সহজতর কাজ কবিতা তারও বেশি কঠিন। তবুও আমি কবিতা লিখেছি। মনের খোরাক মেটাতে মানুষ মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে নানান কথা মিলায়। আমিও মিলিয়েছি। সেগুলোকে আমরা অনুভূতি বলি। আর সেই অনুভূতিগুলো শব্দের ব্যাবহারে বাক্যব হয়ে ওঠাই না হয়েছে কবিতা। সেই অনুভূতির একটা পরিচয় জরুরি ছিল। মলাটবদ্ধ হওয়া অনুভূতির নাম দিয়েছি ‘ক্যাকটাস’।

প্রথম উপন্যাস ‘এপিলেপটিক হায়দার’ প্রকাশ ও গ্রন্থমেলার অভিজ্ঞতা কেমন? কোনো এক মজার স্মৃতি শুনতে চাই..

পাঠকের সাথে সাথে লেখক তকমা নিয়ে বইমেলায় পদার্পণের যে সুখ আর যে ভয় তা যার সাথে ঘটে সে জানে। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। মনে আনন্দ ছিল। লজ্জাও ছিল মারাত্মক। একটু সুযোগ পেলেই প্রকাশনার প্যাভিলিয়ন থেকে সরে গিয়ে অন্যদিকে চলে যেতাম। প্রকাশক জুয়েল রেদওয়ানুর ভাই ফোন দিতেন, ‘কিরে তকিব, গেলে কই? পাঠক এসে ফিরে যায়!’
আমি অবাক হই। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমাকে কেউ—ই জানতো না। আমিও জানান দিয়ে আসিনি। না জানার মধ্যে দিয়ে কেউ একজন কিংবা তারও অধিক কেউ খুঁজে গেলে কতটা উৎফুল্লতা ভর করে ভাবুন একবার! আমি ধীরে এগিয়ে যায়। প্রকাশনায় দাঁড়ায়। পাঠকের সাথে কথা বলি, কপালে ঘাম জমে যায়। অটোগ্রাফ দেই অপ্রস্তুত ভাবে, কাঁপা হাতে। তারপর… এই তো এভাবেই শুরু। ‘এপিলেপটিক হায়দার’ অবশ্যই পাঠকের কাছে ভাল লাগার ছিল তাই এই অবধি আসতে পেরেছি, আল’হামদুলিল্লাহ্।

গত তিন বছরে বইমেলায় আপনার তিনটি উপন্যাসের বই প্রকাশ হয়েছে। প্রথম বই ‘এপিলেপটিক হায়দার’, দ্বিতীয় বই ‘অধ্যায়’ এবং তৃতীয় বই ‘নিদাস্তিয়া’। আপনি কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন?
আমি এই তিন উপন্যাসের লেখক। এই উপন্যাসগুলো আমার সৃষ্টি। একজন আদর্শ পিতার কাছে তার কোনো সন্তান–ই পৃথক স্নেহের নয়। সবাই সমান। বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই।
তবে পাঠক এখন পর্যন্ত ‘অধ্যায়’ এবং ‘এপিলেপটিক হায়দার’ এই উপন্যাসকে–ই এগিয়ে রেখেছে।
একদলের কাছে শুনি অধ্যায়–এর ‘পরিণতির আহাজারি’ অন্যদল চায় ‘নিদাস্তিয়ার পরিত্রাণ হোক’।

শুধু বইমেলায় বই প্রকাশের ব্যাতিক উঠতি অনেক লেখকেরই থাকে। আপনি বই মেলা ছাড়াও সংলাপ বিষয়ক ভিন্নধর্মী একটি বই ‘কাঙালের সংলাপ’ লিখেছেন।এবং কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাকটাস’ আসছে। এটা কি বই মেলা থেকে অন্য রকম একটা অনুভুতি সঞ্চার করে?

আসলে এই প্রশ্নের উত্তর বিশদ এবং অজস্র যুক্তি নির্ভর। বলতে গেলে প্রচুর বলা যায়।
তবুও সংক্ষেপে বলছি, বাংলাদেশের সাহিত্য এতটাই সমৃদ্ধ নয় যে বই লিখে লেখক বছরজুড়ে পরিবার নিয়ে মোটামুটিভাবে সংসার চালিয়ে নেবে। তাদের জীবনের প্রয়োজনে অর্থের প্রয়োজন। সেটা আসে কর্ম থেকে। বই লেখার কর্মটা সেই প্রয়োজন মেটাতে পারে না। তাই সারাবছর বই লিখে যাওয়ার দুঃসাহস অনেকেই করতে পারে না। কেউ কেউ করে হতাশ হয়। কারণ বই বিক্রির উপর যে প্রভাব পড়ে তার জন্য প্রকাশকের কাছে জবাবদিহিতাও করতে হয়। দিনের এবেলায় ওবেলায় প্রকাশক একজন ব্যবসায়ী। তাকেও ভাবতে হয়। তাই সব লেখকের উপর প্রকাশক ভরসা করতে পারেন না। সেটা কারোর ত্রুটি নয়। সেটা আমাদের জীবন ব্যবস্থার দোষ। আমরা অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর সাথে বইকে রাখি না। অপরিহার্য ভাবি না। বাদ দিলেও চলে ভাবি। এটাই সমস্যা। লেখা দীর্ঘ হচ্ছে। থামছি। এই বিষয়ে অনেক বলা যায় আসলে।

আর আমার ‘কাঙালের সংলাপ’ ও ‘ক্যাকটাস’ দুটোই হচ্ছে আমার ব্যতিক্রম কিছু করবার প্রচেষ্টা। জানি না হয়ে উঠে কিনা। তবুও করে থাকি। কারণ আমি মনে করি কখনো কখনো পরাজিত সৈনিকও তার বিজয়ের প্রচেষ্টার সম্মানটুকু সে পায়। ইতিহাস বলে এমনটা ঘটে যেতে পারে। আমি ইতিহাস হতে চাইছি না, আমি ইতিহাসের কবর ছুঁয়ে শ্রদ্ধাটুকি জানান দিচ্ছি বলে বলে ধরে নিতে পারেন অনায়াসে।

বর্তমান সময়ের অনেক লেখকেই আছে সমালোচনা একদম সয্য করেন না। পাঠকদের সমালোচনায় লেখকের উগ্রতাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

সমালোচনা নিতে পারেন না ঠিক তেমন কিনা জানি না! কিন্তু বেশিরভাগ সময়—ই আমার চোখে পড়ে যৌক্তিক্তাহীনভাবে সমালোচনা করা হয়। কখনো কখনো ব্যাক্তিগত জীবনের কথা নিয়েও বলা হয়। এটা উচিত না। একজন সমালোচক একটা শ্রদ্ধার জায়গা। তিনি সংশোধনের পথপ্রদর্শক। কিন্তু সমালোচক হতে যেভাবে যোগ্য হয়ে উঠতে হয় আমরা কি তা পেরেছি?
মূলত গঠনমূলক সমালোচনা জরুরি। এরপরেও যদি কোনো লেখক গ্রহণ না করেন তাহলে ধরে নিন অনেকের মাঝে এমন ক’জন থাকেই, যারা আমি–ই ঠিক বলে দাবি করে যায়। নিজের ত্রুটি আমলে নেয় না।

মাত্রই শুরু আপনার লেখালেখির ক্যারিয়ার।এখনও অনেকটা সময় বাকি। ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যকে করবেন সমৃদ্ধ। তবুও এই সল্প সময়ের যাত্রায় সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে কিছু বলেন..
আল’হামদুলিল্লাহ্। এটুকুতেই ভীষণ সন্তুষ্ট। তবে আমাদের মধ্যে বাংলাসাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করে তাদের নানান দিক পরিমার্জিত করা উচিত। বলে, মনে করি। স্বচ্ছতা এবং পরিচ্ছন্নতার জন্য।

জাতীয় গ্রন্থমেলা-২০২১ নাকি কি হবে না। এ নিয়ে চলছে পাঠক মহলে বেশ গুজব। আপনি কি মনে করেন? এবং বই মেলা নিয়ে আপনার প্রস্তুতি?

জাতীয় গ্রন্থমেলা’২১ হবে কি হবে না এটা সম্পূর্ণ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। পরিস্থিতি এখনো ভালো না। কিন্তু আমরা কীভাবে যেনো মানিয়ে–ই নিয়েছি। এমন চলতে থাকলে করোনার প্রাদুর্ভাব আসলে কোন দিকে গড়ায় সেটা—ই ভাবাচ্ছে।
তবে একটা কথা বলা যায় যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে আর যাইহোক, কোনো মেলা হবার সুযোগ থাকে না। মেলা মানেই আমরা বুঝি জড়ো হওয়া। কীভাবে ঠেকানো যাবে? বরং ঠেকানোর চেষ্টা বোকামি।
বইমেলা’২১ কে সামনে রেখে একটি উপন্যাস আমি ইতোমধ্যে শেষ করেছি। নাম ‘রিঙ্গণপুর’।

প্রিয় তিনটি বইয়ের নাম—
পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ; পঞ্চগ্রাম; মা।

পছন্দের তিন লেখক–
আলাদাভাবে ৩ জন বলা মুশকিল।। কারণ অসংখ্য লেখক–ই বাংলা সাহিত্যের জন্য অবদান রেখে গেছে। এখনও অনেকেই ভূমিকা রাখেন। তবে কয়েকজন লেখকের নাম না বললেই নয়,
কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর, আহমদ ছফা, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং শাহাদুজ্জামান।

তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা-

আমি নিজে এখনও তরুণদের দলে। লেখছি। চর্চায় আছি। আমি যা করি তা যদি বলি, তাহলে বলবো– নিয়মিত পড়ুন এবং জীবনের উপলব্ধি ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন। এটা জরুরি। আপনার পাশের যে জীবন, অল্প দূরের যে জীবন কিংবা অদূর দূরে যে জীবন সব নিয়ে ভাবুন। তাদের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করুন। নিজেকে সেখানে দাঁড় করান। গল্পের অভাব। হবে না। আর পড়ার ক্ষেত্রে প্রচুর জ্ঞান আহরণ সম্ভব আর গল্প বলার ঢংটাও আয়ত্ত করা যায়। গল্প সবাই জানে কিন্তু গল্প বয়ানের ক্ষমতা সবার হয় না।সবাইকে ভালোবাসা জানাই।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *