রবিবার, ১১ জুন ২০২৩, ০৩:৩৭ পূর্বাহ্ন

কুবিতে ধূমপান-রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস গড়া অঙ্গীকারেই সীমাবদ্ধ

  • আপডেট টাইম বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ৩.১০ পিএম

বশেমুরবিপ্রবি টুডেঃ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) ভর্তির সময় ধূমপান ও রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার অঙ্গীকার করলেও তা মানছে না কেও ই। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ভর্তির সময় পূরণকৃত ভর্তি ফরম ও রেজিস্ট্রেশন ফরমেই রয়েছে এ অঙ্গীকারনামা।

অঙ্গীকারনামায় রাজনীতি ও ধূমপান মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার প্রতিশ্রুতি নিলেও ক্যাম্পাসটিতে রাজনীতি ও ধূমপান চলছে লাগামহীনভাবে।
ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি যেমন সরব তেমন শিক্ষক রাজনীতিও। অঙ্গীকারনামায় এসব নিষিদ্ধ থাকলেও ক্যাম্পাসে এর প্রভাব দেখে নিতান্তই বিস্মিত বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা। যে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি সরব এবং প্রকাশ্যেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা করে ধুমপান সেখানে ভর্তির সময় এমন অঙ্গিকার করা নিতান্তই হাস্যকর বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা।

জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার এক বছর পরে ২০০৭ সালের ২৮ মে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৩ টি ব্যাচ এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রথম ব্যাচ থেকেই ভর্তি ফরম ও রেজিস্ট্রেশন ফরমে অঙ্গীকারনামায় রাজনীতি ও ধূমপান মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার অঙ্গীকার নেওয়া হয়। যে অঙ্গীকার বর্তমান ফরমগুলেতেও বলবৎ আছে। অঙ্গীকারনামার প্রথমেই

উল্লেখ রয়েছে,“আমি এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি রাজনীতি ও ধূমপান মুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি মেনে চলতে সচেষ্ট থাকবো।” কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এর চিত্র সম্পূর্ণই আলাদা। শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীসহ শিক্ষার্থীরা জড়িত রাজনীতিতে। দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব ব্যতীত হয়না নিয়োগ, মেলে না পোস্ট পদবী। এখানে সাধারণ শিক্ষক বা শিক্ষার্থী বলতে শুধুই মরিচীকা। যেখানে রাজত্ব সব ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।

এ ক্যাম্পাসটিতে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করছে সর্বত্র। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দই নিয়ন্ত্রণ করে আবাসিক হলগুলো। এমনকি ছাত্র রাজনীতির নিয়মিত কর্মকাণ্ডে যোগদান না করলে মিলে না হলগুলোতে সিট। বাধ্যও করা হয় হল ছাড়তে। ২০১১ সালে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আহবায়ক কমিটি দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ২৪ জুলাই ১০ সদস্য বিশিষ্ট প্রথম কমিটি ঘোষণা করা হয়। যার সভাপতি ছিল নাজমুল হাসান আলিফ ও সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী।

বর্তমানে ছাত্রলীগের ২য় কমিটি চলছে। পূর্নাঙ্গ এ কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ। এ কমিটি দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ২৬ মে। এ কমিটির মেয়াদও দেড় বছর আগে শেষ হয়েছে। ছাত্রলীগের সহিংস রাজনীতি ও দলীয় গ্রুপিংয়ের কারনেই ২০১৬ সালের ১ লা আগস্ট দু’গ্রুপের সংঘর্ষে দলীয় কর্মীদের দ্বারাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তদন্ত কমিটি হলেও আজও তা আলোর মুখ দেখেনি। শুধু সাইফুল্লাহ হত্যাই নয় ছাত্রলীগের নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারির ও সংঘর্ষের ঘটনা রয়েছে অসংখ্য। ২০১৫ সাল থেকে শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদেরসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারধরের শিকার হয়েছে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। মারধরের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। এসব মারধরের বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ জানানোর পরেও একটি ঘটনারও বিচার করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিকদের মারধর ও লাঞ্ছনা, দলীয় নেতাকর্মীদের মারধর, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ থাকলেও বিষয়গুলো বারবারই এড়িয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে আজীবন, সাময়িকসহ বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল নিরব।

এমনকি প্রশাসনের কাছে বিচার দিলে ছাত্রলীগের সাথে বসে সেগুলো মিমাংসা করতেও বাধ্য করতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাই অনেকে মারধরের শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারতো না। শুধু তাই নয় বিচারের আশ্বাস দিয়ে ডেকে এনে আবারও মারধর করার অভিযোগ রয়েছে শাখা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে।

অপরদিকে শাখা ছাত্রদলের কমিটি থাকলেও তাদের নেই কোন কার্যক্রম। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসের দিকে তাদের অবস্থান করার চেষ্টা করলেও ছাত্রলীগের কারণে তা ব্যর্থ হয়। এমনকি বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা মারধরের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছে তাদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থী বলেন,‘আমরা ক্যাম্পাসে ভর্তি হই একটি রাজনীতি ও ধূমপান মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে। কিন্তু ভর্তির পরেই তা ভঙ্গ করতে হয় আমাদের। আবাসিক হলগুলোতে যেখানে থাকবে পরাশুনা করার একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সেখানে হল ছাড়তে বাধ্য হয় পরাশুনা করার জন্য। হলে সিনিয়র হয়েও যেখানে সিট পাওয়া যায় না সেখানে রাজনীতির আধিপত্যে প্রথম দিন উঠেই পেয়ে যায় সিট।’

এদিকে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ধূমপান না করার অঙ্গীকার করলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থীরা হর হামেশাই করছে ধূমপান। শুধু ধূমপানই নয় ক্যাম্পাস অভ্যন্তরে ও আবাসিক হলগুলোতে বসে মাদকের আসর। এসবকিছু নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন,‘ যে ক্যাম্পাসে ধূমপান ও রাজনীতি মুক্ত থাকার অঙ্গীকার করা হয় সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই যদি প্রকাশ্যে ধূমপান করেন তবে সেখানে শিক্ষার্থীরা আর কি শিখবে। শিক্ষার্থীরা শুধু ধূমপানই নয় আবাসিক হলগুলোতে দলীয় ছত্রছায়ায় বসে মাদকের আসর।’ এমনকি বহিরাগতদের নিয়েও ছাত্র হলগুলোতে মাদক সেবন করা হয় বলে জানান আবাসিক হলগুলো বেশ কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা জানান, হলগুলোতে মাদকের আগ্রাসন এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে এখান থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। এ বিষয়ে হল প্রশাসন একেবারেই উদাসীন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে না আসলে বুয়েটের আবরার হত্যার মতো ঘটনা ঘটা তেমন কোন বিষয় হবে না বলে আশঙ্কা শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন,‘বাংলাদেশের কোথাও রাজনীতির প্রভাব ব্যাতীত নেই। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় তো আর তার বাহিরে নয়। তারপরেও এখানে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি যে প্রকট আকার ধারণ করেছে সেটা ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, প্রভোস্টবৃন্দও যেখানে ছাত্রলীগে নেতাদের কথার বাহিরে যেতে পারে না সেখানে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী তো কিছুই না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি হয়ে আছে বলেও হতাশা প্রকাশ করেন বিভিন্ন বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী বলেন,‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বের অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইলেই একবারে সম্ভব না। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা শিক্ষক, ছাত্রনেতা এবং শিক্ষার্থীদের সাথে বসে একটা সমাধানে আসবো। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের আধিপত্যই ক্যাম্পাসে দেখা যায়। এটা একটা রীতি হয়ে গেছে ক্যাম্পাসগুলোতে। যদি ছাত্রনেতারা একসাথে ২০-২৫ জন এসে কোন বিষয়ে চাপ দেয় সেখানে আমারও তো তেমন কিছু করার থাকে না।’



সংবাদ প্রেরক ‘দ্য ক্যাম্পাস টুডে’র কুবি প্রতিনিধি মুহাম্মদ ইকবাল মুনাওয়ার।


 

The Campus Today YouTube Channel

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazar_creativenews_II7
All rights reserved © 2019-20 The Campus Today