কুবি ছাত্রীর শূন্য থেকে উদ্যোক্তা হবার গল্প
ফেনীর মেয়ে মৌরি বৈদ্য। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে বিবিএ এমবিএ শেষ করেছেন। চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছন না ছুটে চিন্তা করেছেন নিজেই কিছু করবেন। সেই চিন্তা থেকেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠা। বাসায় বসেই শুরু করেছেন অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা।
গড়ে তুলেছেন ‘মর্ত্যের অপ্সরী’ নামের প্লাটফর্ম। লক্ষ্য তাঁর বহুদূর যাবার। পড়াশোনা করে শুধু চাকরি নয়, হওয়া যায় উদ্যোক্তাও। নিজের উদ্যোক্তা হবার গল্পটাই শেয়ার করেছেন মৌরি।
‘চিন্তাশক্তি আর রুচিবোধ প্রকাশের সুযোগ নেই যেখানে সেই কাজগুলো কখনোই ভালো লাগতোনা তবুও খুব ইচ্ছে ছিলো MTO পদেই কোন ব্যাংকে জয়েন করে ৬-৭ বছর অনেক টাকা কামিয়ে বুটিক হাউজ দেবো অসাধারণ করে ।
ছোটবেলা থেকেই সাজতে যেমন পছন্দ করতাম তার চেয়েও বেশি ভালো লাগতো নিজের পছন্দে অন্যকে সাজাতে। মানে কাজিনরা, বান্ধবিরা যখন আমার পছন্দে জিনিস পরতো অন্যরকম সুখ পেতাম সত্যিকার অর্থে!
পড়াশোনার বিষয়টা বলি একটু,আমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছি ২০১৬ সালে।ঢাবিতে ডি ইউনিটে চান্স পেয়েও পড়িনি বিবিএ এমবিএ করে ব্যাংকার হবো ভেবে।
পড়াশোনা শেষ করে ইন্টার্নশীপ এর সময় কনসিভ করি,২০১৭ সালের জানুয়ারিতে পুত্রসন্তান হয়।
পুরো ২০১৬-১৭ জার্নিটা একদম একা কষ্ট করার সময়েই টের পেয়েছিলাম সব সামলিয়ে চাকরি হয়তোবা করা হবেনা আমার,তাও আশা ছাড়িনি। অপেক্ষা করছিলাম ছেলেটা একটু বড় হলে চাকরি করবো। কিন্তু যেহেতু পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না, প্রিপারেশন ছাড়া একটা পরীক্ষাও কখনো দেইনি।
কয়েকটা প্রাইভেট স্কুল কলেজের পরিচিত চেয়ারপার্সন অফার করেছিলেন কিন্তু সব ছিলো আমার জন্মস্থান ফেনীতে।বিবিএ ২য় বর্ষে বিয়ে হয়।তার মানে দীর্ঘ সময় বর থেকে আলাদা ছিলাম, বাচ্চাটা বাবা থেকে আলাদা থাকবে সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না একদমই।
আমি ফেনীর মেয়ে, ছোট্ট অতি আধুনিক মফস্বল এলাকাটায় একটা সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে জন্ম, যেখানে মা রিটায়ারমেন্ট এর পরেও স্কুল কর্তৃপক্ষ এক্সটানশন করিয়ে উনাকে রেখে দিচ্ছেন বছরের পর বছর উনার অসাধারণ যোগ্যতার কারনে, আর বাবা ফেনী সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। (এখন প্রাইভেট কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে আছেন) ফেনীজুড়ে একনামেই সুপরিচিতি দু’জনেই।
এমন ঘরের মেয়ে অন্তত বিসিএস না দিয়ে চাকরি না করে ব্যবসাটা ঠিক মানা যায় না, এই কটু কথাগুলো শুনতে শুনতে এখন সয়ে গেছে আসলে।
আমি ভেবেছিলাম ৬ বছর পর যেটা শুরু করবো সেটা যদি শূন্য থেকেই চেষ্টা করা যায় ক্ষতি কি?
মা বাবা মেনে নিতে পারছিলোনা পাবলিক থেকে পড়াশোনা করে মেয়ে জুয়েলারি বানাবে অথবা কাপড় বিক্রি করবে! প্রথমে ঝামেলা হলেও এখন বাবা নেট প্রফিট জানতে চাইলে বেশ গর্ব হয় ।
শুরুটা কঠিন ছিলো খুব।সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিলো যখন দেখছিলাম ব্যাচ এর সবাই জব করে,আমি পাবলিক থেকে পরে যে কাজ করবো সেটা পড়াশোনা না করেও করা যায় এই ধরনের কথা হজম করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ।
তোমার লজ্জা লাগেনা? আসলেই চাকরি করবা না? এতো পড়ে কি লাভ? এই আজেবাজে মন্তব্য গিলে ফেলার সাহস না থাকলে এই লাইনে পা না বাড়ানোই ভালো।
খুব কেঁদেছিলাম যেদিন ২ হাত ভর্তি করে সুন্দরবন কুরিয়ারে যাওয়ার সময় মা বলেছিলো কত স্মার্টলি চলতো মেয়েটা হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে কেমন লাগছে এখন (ফেরিওয়ালা ভেবেছিলো হয়তো )
সীমাহীন কষ্ট পেয়েছিলাম আসলে, কারন নিজের মনের সাথে নিজেই যুদ্ধ করছিলাম আমার সিদ্ধান্ত সঠিক তো? কতটুকু যেতে পারবো এভাবে এসব কোন্দোল চলছিলো নিজের সাথেই সে সময় মায়ের এমন মন্তব্য কষ্ট দিয়েছিলো,কারন আমার মা বাবা অতি আধুনিক,আমরা ২ভাই বোন যেভাবে বড় হয়েছি অনেক উচ্চবিত্তের ঘরেও অনেক সন্তান সেই সুযোগ সুবিধে পায়নি আমি সিউর।
মাকে এখনো অনেক কষ্ট দেই ফেনীতে ডেলিভারি চার্জ নেইনা পিক পয়েন্ট আমাদের বাসা তাই মাকেই অনেক কষ্ট করে স্কুল থেকে ফেরার পথে পার্সেল নিয়ে বাসায় যায়।হিসেব রাখে আবার সেই টাকা পাঠায় ।
আরেকবার ভার্সিটির প্রিয় ম্যাম অনেক কেনাকাটা করার পরে একদিন বলেছিলেন মৌরি আপনার প্রোফাইল এর সাথে এটা যাচ্ছেনা আপনি ভালো জব পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন, অনেক খারাপ লেগেছিলো আবারো চিন্তাভাবনা টালমাটাল অবস্থা কি যে করি!
২০১৮ এর এপ্রিলে শুরু করি ফেনী থেকেই। জুয়েলারি মেটারিয়াল কিনলাম, নিজেদের মধ্যেই শুরু করলাম বিক্রয়। প্রথম ক্লায়েন্ট কাজিন ঝুমুদি, বান্ধবিদের মধ্যে আফরিন।ওদের দারুন উৎসাহ না পেলে ধরে রাখতেই পারতাম না।পরে দেখলাম বাচ্চার জন্য জুয়েলারি বানাতে পারছিনা,শুরু করলাম কাপড়ের ব্যবসা ছোট মামা থেকে এনে বিক্রয় করতাম।
এরপর প্রতিবেশি, বান্ধবীরা, কাজিনরা কেনা শুরু করলো,নিজের উপর আস্থা এলো। এরপর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এর টিচার থেকে শুরু করে পরিচিত অপরিচিত অনেকেই।
আমি নিজের একটা অবস্থান তৈরী করতে চাইতাম সবসময়, ক্যাম্পাসে সুপরিচিত ছিলাম বলে হয়তো বিষয় টা পজিটিভ হলো। খুব কম ইনভেস্টমেন্ট দিয়ে শুরু করে রিইনভেস্ট করে করে এতোটুকু এসেছি বাকিটা আপনাদের দোয়া আর আশির্বাদ।
করোনাকালে খুব বেশি সেল না হলেও,বেঁচে থাকলে আমি জানি আবার জমবে মেলা যদি সততা ধরে রাখতে পারি বরাবরের মতো।অনেক কিছু লেখার একটাই উদ্দেশ্য, জীবনে হতাশ হওয়া যাবেনা।গর্ব করে বলতে হবে আমি যাই করিনা কেনো যে পথেই হাঁটিনা কেনো সফল হতে জানি।
কর্মজীবী মায়ের সন্তানকে দেখার কেউ না থাকলে মা আর সন্তান দুইজনেরই কষ্ট,সব ব্যালেন্স করতে গিয়ে আমার মাকেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো তবুও শান্তি একজন বিশ্বস্ত সাহায্যকারী ছিলো আমাদের বাসায় ২০ বছর যা এই যুগে মেলা দুষ্কর।
তাই সব মিলিয়ে মাতৃত্বকেই প্রাধান্য দিয়ে ৬ বছর পরে যা শুরু করতাম তা শূন্য থেকেই শুরু করলাম।এখনো আমার সন্তানের কথা মাথায় রেখে আমার অনেক কাজই করা হচ্ছেনা, বাঁধা আসে তবে মস্তিষ্ক কে অলস করে রাখলে হতাশার জন্ম নেয়, তাই সকল নারীদের বলবো ইনকাম্বেন্ট হতে হবে।বর থেকে ফোনে রিচার্জ করে দাও এটা বলতে যদি সংকোচ হয় তারমানেই আপনি আয় করার প্রয়াসী,এই সংকোচবোধের যোগ্যতাকে পুঁজি শুরু করে দিন আজকেই।
আমার জন্য সবাই আশির্বাদ করবেন যেনো নিজের পছন্দে সবাইকে সাজাতে পারি।