কেমন শিক্ষক চাই!

কেমন শিক্ষক চাই!

মোঃ মোজাহেদুর ইসলাম ইমন


গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার মূল উপাদান হলো- মানসম্মত শিক্ষক, মানসম্মত শিক্ষা উপকরণ ও মানসম্মত শিক্ষা পরিবেশ। এই তিনটি উপাদানের মধ্যে শিক্ষকই একমাত্র চলক যার উপর অন্যান্য উপাদানের ভালমন্দ নির্ভর করে। এই শিক্ষকই আমাদের সমাজের বিবেক। তাই সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে।

কিন্তু কালে কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও মানবসভ্যতার বিকাশের ধারায় পুঁজিকেন্দ্রিক সামাজিক কাঠামোর বিকাশ লাভের ফলে শিক্ষকদের মর্যাদা এখন আর আগের মতো নেই। বাস্তবে বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ আজ প্রশ্নে সম্মুখীন। কারণ পাস করা সার্টিফিকেটের জোরে যে কেউ শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পরছে কিন্তু সেই ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে কেমন তা যাচাই করার কোন উপায় নেই।

একজন শিক্ষক অবশ্যই সৎ ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবেন। কিন্তু সার্টিফিকেট মেধার মূল্যায়ন করলেও মনুষ্যত্বের মূল্যায়নের ক্ষমতা রাখে না। ফলে শিক্ষকতা পেশায় থেকেও নানা অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পরছে। এবং এজন্য শিক্ষক সমাজের প্রতি আঙুল উঠছে। শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল দরকার কারণ শিক্ষকদের দায়িত্ব অন্য সব পেশা থেকে ভিন্ন। তাছাড়া শিক্ষকতা হলো সেই পেশা যেখান থেকে দেশের মেধা তৈরি হয়। ফলে আর সব পেশার সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। তাই এই পেশার সাথে জড়িত মানুষগুলো আলাদা বেতনস্কেল দাবি করতেই পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকতা পেশায় কারা আসে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় মেধার ভিত্তিতে যদি ভাগ করা হয় তাহলে উচ্চ মেধা সম্পন্ন ছাত্রছাত্রীরা কমই শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। প্রথম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা তাদের স্বপ্নকে বেঁধে রাখে বিসিএস,ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা এরকম কোন পেশায়। যেখানে প্রচুর টাকা কামানো পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক সম্মান। এরপরের মেধাবী রয়েছে তারা প্রথম শ্রেণিতে না পড়লেও দ্বিতীয় শ্রেণির মেধাবী। তারা নূন্যতম দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি খোঁজে। এরপর যারা থাকে তারা অন্য পেশার সাথে শিক্ষকতা পেশায় আসে।

এখন কথা হলো কেন রাষ্ট্রের সবথেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক এমনকি কলেজে আসতে অনীহা। কেন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াতে বেশি আগ্রহী। এর একটাই অর্থ যে প্রাথমিক বা বেসরকারি স্কুল কলেজের চাকরি প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির নয়। ফলে প্রথম শ্রেণি বা দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি খোঁজা একজন মেধাবী কেন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেবে?

অনেক উন্নত দেশেই প্রাথমিক শিক্ষকদের মানে শিক্ষকদেরই মর্যাদা সর্বাধিক। তাদের বেতন ও সুযোগ সুবিধাও বেশি। বড় বড় চাকরি ছেড়ে তাদের প্রধান লক্ষ্যই হয় শিক্ষকতা করা। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা ঘটছে না। বড় বড় ইঞ্জিয়াররা বড় বড় দালানকোঠা,বিল্ডিং তৈরি করেন। তবে এসবের থেকেও যা আজ বেশি দরকার তা হলো মানুষ। একমাত্র শিক্ষকরাই সে কাজটি করতে সক্ষম।

শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের জীবন ও যুগোপযোগী শিক্ষা দেবেন। তাদের জ্ঞান অর্জনের পথ দেখাবেন, আলোর পথের যাত্রী করবেন। শিক্ষার্থীদের ভেতর জ্ঞান লাভ,অজানাকে জানা,অদেখাকে দেখা এবং চেনা-জানা বিষয়গুলোকে নতুন করে চেনার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেবেন। উৎসাহ, প্রেরণা,শক্তি যোগাবেন। ভালো-মন্দ, ভুল-সঠিকের দৃষ্টিভঙ্গি শেখাবেন। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন।

শুধু পুঁথিগত বিদ্যা বিতরণ নয়; মানুষ হয়ে উঠতে ছাত্রছাত্রীদের যা যা প্রয়োজন, সব শিক্ষা দেওয়া একজন শিক্ষকের কর্তব্য। তিনি ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে বলবেন, রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করবেন, দেশপ্রেমের শিক্ষা দেবেন। তাই শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গঠনের কারিগর। পাঠদানের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা, তাদের গাইড করাও শিক্ষকের দায়িত্ব।

সকালবেলা যাব, বিকেলে ফিরব, মাস শেষে বেতন নেব- এর নাম শিক্ষকতা নয়। এর বাইরেও শিক্ষকদের অনেক কিছু করতে হয়। যার জন্য চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্ন থাকবে না। তাই শিক্ষকতা শুধু একটা পেশা নয়; একটি ব্রত। বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষকের মধ্যে এই চিন্তাটা নেই। তারা ভাবেন, এটা করে আমার কি লাভ? আমি কেন করব? শিক্ষকতা করতে গিয়ে সব সময় অর্থের চিন্তা করলে এ পেশায় না আসাই ভালো।

লেখক: মোঃ মোজাহেদুর ইসলাম ইমন
শিক্ষার্থী, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *