কেমন হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র!

কেমন হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র!

ড. মো. তরিকুল ইসলাম


অধিক জনসংখ্যা ও দরিদ্র এই দেশটিতে (বাংলাদেশ) হয়ত আমরা হার্ভাড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোনো দামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবো না। কেননা সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ছাড়াও মানসম্মত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিয়েও রীতিমত ঘাটতির প্রশ্ন রয়ে যায়।

মূলত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান কেমন তা উক্ত বিষয়গুলির মানদন্ড ছাড়াও দেশীয় ও বৈদেশিক কর্মক্ষেত্রে তার থেকে প্রাপ্ত জনশক্তির কর্মদক্ষতা বা অবদানের উপরেও নির্ভরশীল।

একটি মানসম্মত শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত নিশ্চিত করাটাও অত্যন্ত জরুরী। এদিক থেকে হয়ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সার্বিক দিকে মানের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়- কিন্তু এই বিশাল জনশক্তিকে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হলে নিশ্চয়ই একটি মানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে।

কেননা এত বড় একটি জনগোষ্ঠী থেকে মানসম্মত শিক্ষার্থী ও অভিজ্ঞ শিক্ষক গোষ্ঠী বের করা মোটেও অসম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধাভিত্তিক পরিচর্চা হতে পারে একটি ফলপ্রদ পদক্ষেপ।

শিক্ষাকার্যক্রমটি নাম্বারকেন্দ্রিক সনদে রূপান্তর কিংবা শুধুমাত্র স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে না নিয়ে বরং একে তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন- (১) আবশ্যিক বা মৌলিক অংশ: যেহেতু শিক্ষা একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার সেহেতু ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাব্যবস্থার এ পর্যায়টিকে নিশ্চিত করতে হবে।
এটিকে আবশ্যিক বলছি একারণেই- এখানে শিক্ষার্থীদেরকে প্রাথমিক জ্ঞান-শিক্ষা নিশ্চিত করা যেতে পারে, যেমন- ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা, মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ, দেশীয় আইন বা নিয়ম-কানুন, অত্যাবশ্যকীয় সাধারণ জ্ঞান, ইত্যাদি। এককথায় একজন সাধারণ মানুষের জীবনধারনে অপরিহার্য বিদ্যাশিক্ষাদান করাই এ স্তরের মূল উদ্দেশ্য।

বিশাল এই জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ অংশ হয়ত এর আওতায় সরকারের পক্ষেও আনা সম্ভব না হতে পারে, তাই এই স্তরটির সময়সীমা নির্ধারনও করতে হবে সেভাবে যেন সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থাপনা থেকে একজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়লেও অন্তত এই স্তরটি সমাপ্ত করার সুযোগ সে পায়। সেই সাথে এ স্তরেই ছড়িয়ে দিতে হবে পরবর্তী স্তরে পৌঁছাবার আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা।

(২) দক্ষতা অর্জন অংশ: দরিদ্র ও ঘনবসতির এই দেশটিতে কর্মদক্ষ জনশক্তি গড়া এবং শিক্ষাজীবনের পরবর্তী স্তরে মেধা স্থানান্তর করাই এ স্তরের মূল লক্ষ্য। এ স্তুরে শিক্ষার্থীদেরকে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদান করা হবে যেন তারা দেশ বিদেশের কর্মক্ষেত্রে নিজেদের মেধা ও শ্রমকে সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারে।

(৩) অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞতা অংশ: দ্বিতীয় স্তর থেকে একটি বিশেষ শ্রেণিকে বিশেষত যারা দক্ষ এবং অধিক দক্ষতা অর্জনে অর্থাৎ অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ হতে ইচ্ছুক বা হওয়ার সক্ষমতা রাখে তাদেরকে ব্যক্তিগত, বিশেষ অনুদান (ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক) ও সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রতিপালন করা যেতে পারে। এটি মূলত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষাকার্যক্রম।

এখানে শিক্ষার্থীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (যেমন- অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি, পোস্টডক্টরেট) বিষয়ক জ্ঞানচর্চা করবে। এতে করে দেশীয় সম্পদ ও শিক্ষার্থীদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন ও প্রয়োগবিধি নিশ্চিতকরণে সুবিধা হবে। তবে, এর জন্য আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলিকেও সাজাতে হবে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর অনুযায়ী।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ইদানীং বহু চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠান চাকরীর বিজ্ঞাপনে আবেদনকারীদের কাছ থেকে পদমর্যাদাতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা দাবি করেন; যা বেকারত্ব বৃদ্ধি ছাড়াও জন্ম দিচ্ছে নানারকম অনিয়ম ও দুর্নীতির। এতে শিক্ষা ও সনদের মান এবং মূল্যায়ন দুটোই কমে; বেড়ে যায় নাম্বারভিত্তিক সনদের শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রতিযোগিতা।

এছাড়াও বেড়ে যায় পদকেন্দ্রিক যোগ্যতা ও দক্ষতার অবদমন, কর্মক্ষেত্রে মেধা ও দক্ষতার অবমূল্যায়ন- তুদপরি অসম বা অকার্যকরি বণ্টন, আর্থিক (উপঢৌকন) ও ক্ষমতার (যেমন- ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক) প্রভাবশালিত্ব, এবং শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক খরচ- মতান্তরে দেশীয় সম্পদ ও মেধার অপচয়। আমাদের এটি ভুললে চলবে না যে – গুনমানে পরিমাণ প্রহারিত হয়। শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য ও মন না চাইলেও যেন সবাইকে উচ্চশিক্ষার আসর পর্যন্ত জোরপূর্বক টেনে আনতে না হয় সে ব্যবস্থার সুরাহা প্রাথমিক পর্যায় থেকেই করতে হবে।

একজন রোগী যখন পরপর ১০ জন ডাক্তারের নিকট গিয়ে সঠিক চিকিৎসা পায় না তখন স্বভাবতই সে ধরে নেয় এদেশে উপযুক্ত ডাক্তার নেই এবং সে সঠিক চিকিৎসাও পাবে না; শরণাপন্ন হয় বিদেশের ডাক্তারের প্রতি। আমরা অধিকংশই আজ ঠিক এই অবস্থানেই দাঁড়িয়ে রয়েছি।

একজন শিক্ষার্থী ৮০ নাম্বার পেয়ে এ+ পেল আর অপরজন ১০০ পেয়ে পেল, দুজনের মধ্য পার্থক্য নিশ্চয়ই চোখে পড়ার মত! শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার করে দেয়া ও তদনুযায়ী ট্রিটমেন্ট দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করা অর্থাৎ তাদেরকে দৃশ্যত জনশক্তিতে রূপান্তর করার গুরুদায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে। আর এ কাজে সার্বিক সহায়তা দেবে শিক্ষার্থীর পরিবার ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা।

শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান বা দক্ষতাভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি নিশ্চিত করা না গেলে শাখাভিত্তিক ও বিশেষায়ণ জ্ঞানচর্চায় ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষায়িত বিষয়ের অন্তরালে শিক্ষার্থীরা মত্ত হয়ে পড়ে ভিন্নতর (চাকুরীর জন্য) জ্ঞানচর্চায় যা গুনগত ও সংখ্যাগত উভয় দিক দিয়েই বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার অন্তরায়। পারতপক্ষে, মানসম্মত দ্রব্য উৎপাদনেও বিশেষজ্ঞের প্রত্যক্ষ ছোঁয়ার বিকল্প নেই।

আমাদের শিক্ষা- ও কর্মক্ষেত্র-ব্যবস্থাপনায় যেথকটি শ্রেণি খুঁজে পাওয়া যায় তা হল- (১) পছন্দনীয় দক্ষতা অর্জন ও পছন্দ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র (অতি নগণ্য); (২) পছন্দনীয় দক্ষতা অর্জন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র নয় (অধিক); (৩) পছন্দ মোতাবেক দক্ষতা অর্জন নয় বরং কর্মক্ষেত্র (নগণ্য); এবং (৪) পছন্দ মোতাবেক দক্ষতা ও কর্মক্ষেত্র কোনটিই নয় (অধিক)।

এককথায়, শিক্ষার্জন ও জীবনধারনের সর্বস্তরে উপভোগ্য সময় অতিবাহিত করতে হলে মেধা ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা অত্যন্ত আবশ্যিক।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *