কে সেই ‘ডাক্তার ভাই’, যাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড়

কে সেই ‘ডাক্তার ভাই’, যাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড়

ক্যাম্পাস টুডে ডেস্কঃ টানা ৩৬ বছর টাংগাইল জেলার মধুপুর থানার কালিয়াকৈরে গ্রামের দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা দেয়ার পর মারা যান ডাক্তার ভাই হিসাবে পরিচিত ডাক্তার এড্রিক বেকার। দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হলে অনেকেই চেয়েছিলেন- উনাকে ঢাকাতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দিতে। তিনি ঢাকা যাননি। তাঁর তৈরি করা হাসপাতালেই তিনি ২০১৫ সালে মারা যান।


ডা. এড্রিক সার্জিনসন বেকারের পরিচিতি


পুরো নাম ডাক্তার এড্রিক সার্জিসন বেকার। গরীব মানুষের কাছে যিনি “ডাক্তার ভাই” নামেই পরিচিত। গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান এই মন্ত্রে উজ্জীবিত একজন ঋজু মানুষ হিসেবে ১৯৭৯ সালে এড্রিক বেকার বাংলাদেশে আসেন। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্য সেবা দেবার নিমিত্তে গড়ে তোলেন ‘কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার সেন্টার’।

শুরুতে যেটি ছিল একটি ছোট বৃক্ষের ন্যায়, আজ তা রুপ নিয়েছে বিশাল বটবৃক্ষে। টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ জেলার দরিদ্র মানুষদের জন্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র এক আশির্বাদ।


জন্ম, শৈশব এবং লেখাপড়া


জন্ম, শৈশব এবং লেখাপড়া ডাক্তার এড্রিক ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এই শহরেই প্রাথমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক লেখাপড়া শেষ করে ১৯৬০ সালে তিনি ডুনেডিন শহরের ওটাগো মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৫সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

মেধাবী ছাত্র বেকার এরপরে ১৯৭০ সালে পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েশনের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে গমন করেন। সিডনিতে ট্রপিকাল মেডিসিনের উপর ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন সম্পন্ন করে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ধাত্রীবিদ্যার উপর ডিপ্লোমা লাভ করেন ১৯৭১ সালে। জ্ঞানের জন্য তৃষ্ণার্ত পাগল এই মানুষটি ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিশু বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন।

যা কিছু মহান কীর্তি মিস্টার বেকার ছোট বেলায় নিজ হাতের আঙ্গুল কেটে যাবার ব্যাথা থেকে ডাক্তার হবার অনুপ্রেরণা লাভ করেন তাঁর মায়ের কাছে থকে। ছোট বেলা থেকেই তিনি আর্তমানবতার জন্য কিছু করার তাড়না বোধ করতে থাকেন। ডাক্তার হবার মধ্যে দিয়ে তাঁর দ্বার খুলে যায়। এমবিবিএস পাস করে সরকারের শল্য চিকিৎসক দলের সদস্য হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে যান তিনি। সেখানে কাজ করার সময়ই তিনি পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারেন। যুদ্ধকালীন ও তার পরবর্তী এখানকার মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখে তিনি ঠিক করেন সম্ভব হলে বাংলাদেশে আসবেন।

সেই পরিকল্পনা থেকেই ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে আসার পর তিনি মেহেরপুর জেলার বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮১ সালে তিনি টাঙ্গাইল চলে আসেন এবং শিশু বিষয়ক মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কুমুদিনী হাসপাতালে জয়েন করেন। সেখানে মন টিকাতে না পেরে চলে আসেন
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায়। মধুপুরের থানার বাইদের চার্চ অফ বাংলাদেশ হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার ইনচার্জ হিসেবে কাজ আরম্ভ করেন। এই দায়িত্ব ২০০৪ সাল পর্যন্ত পালন করেন।

“গরীবদের চিকিৎসা, গরীবরাই তা করবে” এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যতিক্রমী চিকিৎসাকেন্দ্র ‘কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার সেন্টার’। ২০০ শতক জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০ রোগী ফ্রি চিকিৎসাসেবা পেয়ে থাকে। ছোট ছোট মাটির ঘরে ডায়াবেটিস বিভাগ, যক্ষ্মা বিভাগ, মা ও শিশু বিভাগ, প্রশিক্ষণ কক্ষ, মাতৃসদনসহ নানা বিভাগ রয়েছে। সব বিভাগ মিলিয়ে ৪০ জন রোগী ভর্তি করানোর ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। সাভারের গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ থেকে দুইজন ইন্টার্ন ডাক্তার সেখানে নিয়মিত সেবা দিয়ে থাকেন।

মৃত্যুর পূর্বে তিনি চেয়েছিলেন- এই দেশের কোনো মানবতবাদী ডাক্তার যেন গ্রামে এসে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালের হাল ধরে। কিন্তু হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে প্রচারিত প্রতিবেদন অনুসারে – এ দেশের একজন ডাক্তারও তাঁর সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

দেশের কেউ সাড়া না দিলেও তাঁর আহ্বানে সূদর আমেরিকা থেকে ছুটে এসেছেন- আরেক মানবতাবাদী ডাক্তার দম্পতি জেসিন এবং মেরিন্ডি।

যে দেশে যাওয়ার জন্য দুনিয়ার সবাই পাগল। শুধু নিজেরা যে এসেছেন তা না। নিজেদের সন্তানদেরও সাথে করে নিয়ে এসেছেন। ভর্তি করে দিয়েছেন গ্রামেরই স্কুলে। গ্রামের শিশুদের সাথে খেলছে । ডাক্তার জেসিন কী সুন্দর করে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আমরা সুযোগ পেলেই গ্রাম থেকে শহরে ছুটি। শহর থেকে বিদেশ পাড়ি দেই। শিশু জন্মের পর থেকেই চিন্তা থাকে কত দ্রুত সন্তানকে আধুনিক মিডিয়াম ইংরেজি স্কুলে বাচ্চাকে পড়াবো। লুঙ্গি পরাতো আমাদের রুচির সাথে আজ বড়ই বেমানান। লুঙ্গি পরতে পারিনা বলতে পারলে- আমাদের আভিজাত্যের পারদ শুধু একটুকু না অনেকটুকুই বাড়ে। বনানী গুলশান পশ এলাকায়তো একবার লুঙ্গি পরাই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। কারণ- ওরা জানেনা- ওদের প্লেটে যে খাবার যায়- তা এদেশের লুঙ্গি গামছা পরা কৃষকরাই তোলে দেয়।

শিশুরা কত সুন্দর করে ইংরেজি বলতে পারে- বাবা মায়ের গর্বের শেষ নেই। একটা কবিতাতো আছে-সম্ভবত এরকম যেন লাইনগুলো-বাবা-মা খুব অহঙ্কার করে সন্তানদের নিয়ে বলছেন “জানেন মশাই, ওদের বাংলাটা ঠিক আসেনা”।

দেশপ্রেম মাটি, মমতা, মানুষ ইত্যাদি নিয়ে আমরা কত কথাই বলি। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি- জাতীয় সংগীত। সোনার বাংলার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কত বেশি- তা একবার ইউরোপ আমেরিকার এ্যাম্বেসীর সামনে দেখা গেলেই বুঝা যায়। কাকডাকা ভোর থেকেই বিদেশের স্বপ্নের আশায় মানুষের লাইন।


অর্জন


সবচেয়ে বড় অর্জন মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা। বাংলাদেশের খ্যাতিমান নির্মাতা এবং উপস্থাপক হানিফ সংকেত ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর এড্রিক বেকারের ওপর একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেন বিনোদন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে। প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষের সেবা দেয়ার অবদান স্বরপ বাংলাদেশ সরকার জনাব বেকারকে ২০১৪ সালের পাঁচ আগস্ট নাগরিকত্ব দেয়।

১৯৯৯ সালে নিজদেশে তিনি” Officer of the New Zealand Order of Merit” পুরষ্কারে ভূষিত হন। ২০১৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর এই মহান সেবকপরলোকগমন করেন। শারীরিকভাবে ব্যক্তি বেকারের প্রস্থান ঘটলেও তাঁর আদর্শকে বুকে ধারণ করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ‘কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার সেন্টারে” কর্মরত ১০০ স্টাফ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *