জন্মদিনের শুভেচ্ছা দুঃসাহসিক শেখ জামাল

জন্মদিনের শুভেচ্ছা দুঃসাহসিক শেখ জামাল

মো. মেজবাহুল ইসলাম


বাবা, বড়ভাই বেঁচে আছেন কিনা জানেন না।গ্রেফতারের প্রায় ৫ মাস বন্দীদশায় উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় কাটছে দিন। মনে তীব্র আগুন,বুকে অসীম দেশপ্রেম। নিজ সত্তার কাছেই মৃত্যু হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে বসে থাকা যায়না!মৃত্যু যেখানে অবধারিত নিয়ে নিলেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

৫আগস্ট, ১৯৭১ পাকিস্তানী বাহিনীর বন্দি শিবিরের কাঁটাতার পেড়িয়ে বের হয়ে আসলেন। বাতাসে লাশের গন্ধ, চারিদিকে শত্রুর স্টেনগান, মৃত্যুপুরী পেরিয়ে পালিয়ে যান ভারতের আগরতলায়।

বলছি, হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২য় পুত্র অসীম দুঃসাহসিক তরুণ শেখ জামালের কথা।১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারে অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়।বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁর পরিবারকে ধানমন্ডিতেই কারান্তরীণ করা হয়। সেখান থেকে ৫ আগস্ট পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদেন শেখ জামাল।

শেখ জামালকে বন্দীশিবিরে দেখতে না পেয়ে তাকে অপহরণের অভিযোগ তুলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। সারাবিশ্বে আলোড়ন, বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের ছেলেকে গায়েব করেছে।

বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে শেখ জামাল আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে পৌঁছলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে। মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে শেখ জামাল ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

কিন্তু জামালের এই খবরটা সঙ্গত কারণেই একেবারে চেপে যায় স্বাধীন বাঙলা প্রবাসী সরকার, কারণ এই ইস্যুতে প্রবাস সরকার এবং ভারত সরকারের তীব্র চাপে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচণ্ড বেকায়দায় পড়েছিল পাকিস্তান সরকার।২ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের যেসব আলোকচিত্র আসে তার একটিতে সীমান্তের ১০ মাইল ভেতরে একটি রণাঙ্গনে সাবমেশিনগানধারীদের একজন হিসেবে ছবি ওঠে জামালের।

রণাঙ্গনে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল, ক্যাম্পে বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরের উদ্দীপনামূলক ভাষণ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক অনুপ্রাণিত করেছিল।দেশ স্বাধীন হলে যুদ্ধের পোশাকেই যুদ্ধের ফ্রন্ট থেকে শেখ জামাল ঢাকায় ফেরেন ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। বড় বোন শেখ হাসিনা, ছোট বোন শেখ রেহানা ও ছোট ভাই শেখ রাসেলের সে কী আনন্দ!

ওই দিনই বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম আয়োজিত স্বাধীন বাংলায় ঢাকার পল্টনে প্রথম জনসভায় উপস্থিত ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালের ২৯ শে জানুয়ারী যুগ্লোশোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে আসলে শেখ জামালের সেনাবাহিনীর প্রতি তীব্র আগ্রহ দেখে তাঁকে যুগ্লোশোভিয়ার সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন।

১৯৭৪ সালের বসন্তে ঢাকা কলেজের ছাত্র জামাল যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু একেবারে ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া আর ভাষার অসুবিধার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো শেখ জামালের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছিল। এই পরিস্থিতিতে মার্শাল টিটো শেখ জামালকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেন।

স্যান্ডহার্স্টের শর্ট সার্ভিস কমিশনের সুকঠিন গ্র্যাজুয়েট কোর্সটির মেয়াদ ছিল প্রায় ছয় মাস (৩ জানুয়ারি থেকে ২৭ জুন ১৯৭৫)। ৪০০ জন ক্যাডেটের মধ্যে বিদেশি ক্যাডেটদের সংখ্যা ছিল ৩০। স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে ফিরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের পোস্টিং হলো ঢাকা সেনানিবাসস্থ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে।ক্যাপ্টেন নজরুলের অধীনে শেখ জামালের রেজিমেন্টজীবনের হাতেখড়ি হলো ‘কম্পানি অফিসার’ হিসেবে। ইউনিটে যোগদানের দিন সেনাবাহিনীর খাকি ইউনিফর্ম পরে বাড়িতে ফেরেন শেখ জামাল।

মুগ্ধ চোখে স্মার্ট এক আর্মি অফিসারকে দেখেন পিতা শেখ মুজিব ও মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ১৪ আগস্ট রাতে ব্যাটালিয়ন ডিউটি অফিসার হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে আসেন তিনি। একজন সুবেদার বলেন, ‘স্যার, অনেক রাত হয়েছে; আজ রাতে ইউনিটেই থেকে যান।’ কিন্তু রাতে আর সেনানিবাসে থাকা হয় না শেখ জামালের। তিনি ফিরে আসেন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে। বাংলাদেশের কলঙ্ক ‘ঘাতক দল’ ততক্ষণে প্রস্তুতি।


লেখকঃ সহ সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *