ডিজিটাল নেশার আসক্তি

ডিজিটাল নেশার আসক্তি

মনসুর হেলাল


বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আমরা তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের কাজের পরিধি আরও বাড়ানো চেষ্টা করছি। এক দিকে আমরা যেমন সুবিধা পাচ্ছি আর অন্যদিকে এর প্রতি আসক্ত হয়ে নানান সমস্যায় পড়ছি। পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ মানুষই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত। এর এক ব্যাপক প্রভাব পড়ছে সমাজে। কিন্তু আমরা কি জানি! যে আমাদের শরীরে এর প্রভাব বিস্তার করছে? এরকম সমস্যা বিষয়ে আমাদের জানা অত্যন্ত জরুরী!

ডিজিটাল কোকেন: বর্তমান অনলাইন আসক্তিকে মনোবিজ্ঞানীরা ডিজিটাল কোকেন নামে অভিহিত করেছেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ফেইসবুক যারা ব্যবহার করছেন তারা অনেকেই বলছেন নতুন কোনো বিজ্ঞপ্তি বা নোটিফিকেশন এলো কিনা! এই নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করে। আর একবার ঢুকলে কিভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায় তা যেনো তারা টেরই পান না।মাদকাসক্তি আর মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন ব্যবহারকারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না।

এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাদকাসক্ত আর মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন ব্যবহারকারীর ব্রেইন এ একই রকম তারতম্য দেখা মিলেছে। দুই জনেরই মস্তিষ্কের সামনে এক ধরনের ওয়েট মেটার থাকে।যখন মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন ব্যবহার আর মাদকের প্রতি আসক্ত হয় তখন মস্তিষ্কের ওয়েট মেটারগুলো নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে।নিয়ন্ত্রণ হারা থেকে শুরু করে মানুষের আবেগ, মনোযোগ এবং সিদ্ধান্তকে ক্ষতি দিকে নিয়ে যায়।এর ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনাকে নষ্ট করে দিতে পারে আবেগ, মনোভাব এবং কি সঠিকভাবে পথ চলার।

মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামে এক ধরনের কেমিক্যাল নিঃসৃত হয় কিন্তু হঠাৎ যদি এমন কিছু ঘটে যা প্রত্যাশার চেয়ে ভালো তখন আকস্মিকভাবে বেড়ে যায় এই ডোপামিনের প্রবাহ ধীরে ধীরে ভালো লাগা কারণগুলো আরও ভালো লাগাতে সহায়তা করে ডোপামিন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু আশা বা প্রত্যাশা গ্রহণ করাই হচ্ছে আসক্তি।

মনোযোগের ক্ষমতা নষ্ট করে: মাত্রাতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের মনোযোগের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।প্রতিনিয়ত আমরা যখন অনলাইনে মনোযোগ সহকারে কাজ করি বা অন্যান্য কাজ করি তখন পাশে থাকা মোবাইল বেজে উঠলো কিনা অথবা বেজে উঠেছে এই নিয়ে একটা বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।মাঝে মাঝে মনে হয় পকেটে থাকা মোবাইলে কেউ কল বা ভাইব্রেশনে হচ্ছে।কিন্তু পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলে দেখা যায় কেউ কল বা ভাইব্রেশন হয়নি।কিন্তু আমরা এর আসক্তি বা ব্রেইন সিনড্রোমে পড়ে যাচ্ছি।

আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটাকে আমরা নিজেরাই অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে ফেলছি।রাস্তা-ঘাটে, দোকান পাঠে, চেপা চিপায়, মেইন রাস্তার পাশে, মসজিদে, বাড়ির ছাদের ভয়ঙ্কর জায়গায় নিয়মিতভাবে মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন ব্যবহারে আসক্তি হচ্ছি।কোনো এক ছেলেকে দেখলাম যে, মোবাইল হাতে নিয়ে অনবরত চ্যাট করে রাস্তা পাড় হচ্ছিলো, এমন সময় একটি ইট তার পায়ে লাগে, ছিটকে মোবাইলটা পানিতে পড়ে গেলো!ভাগ্য ভালো যে,গাড়ি চাপায় পড়েনি। কেউ গাছের সাথে, কেউ মানুষের সাথে আবার কেউ পড়ে গিয়ে পানিতে। এই রকম কতো ঘটনা যে আমাদের চারপাশে দেখতে হচ্ছে তাতো বলা মুশকিল! তার মানে নেশা-দ্রব্য খাওয়ার চাইতে মাত্রাতিরিক্ত অনলাইন ব্যবহারকারীর অবস্থা ভয়াবহ।

বর্তমান সময়ে আমাদের প্রজন্ম লাগাম ছাড়া অশ্লীলতা আর অসামাজিক বেহায়াপনায় গা ভাসিয়েছে,অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই!আমরা সকলেই ভালো ছেলে। মদ বা নেশা জাতীয় কোন কিছু সেবন করি না। কিন্তু এর চাইতে মারাত্মক বিষয় নিয়ে মেতে উঠতে দেখি।আমরা শুধু ভাবি যে,মদ, গাজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, ভাং, হেরোইন আরও যত নেশা জাতীয় দ্রব্য আছে এই সকল জিনিসই আসক্তি করে! কিন্তু বিষয়টা তা নয়।এই জাতীয় আইন এর পদক্ষেপ থাকলেও অনলাইন আইনের অসামাজিকতা আওতায় পড়ে না।এগুলো আমাদের নিজ নিজ দায়িত্বে বা নিজের আইনে পদক্ষেপ নিতে হবে,নইলে আমাদের আর মদ বা নেশা জাতীয় মানুষদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।

পর্ণ ভিডিও আর অসামাজিক অনলাইন সাইটগুলো আমাদেরকে একটা জালে আবদ্ধ করে রেখেছে।

পর্ণ দেখা আর মাদক সেবনের মধ্যে পার্থক্য কি: মাদকদ্রব্য বা নেশাগ্রস্ত কিছু সেবনের ফলে মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামে এক ধরনের রস নিঃসৃত হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রত্যাশা আসক্তিতে পরিণত করে।যা নাকি আমাদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলে।আবার মাত্রাতিরিক্ত ডোপামিন রিলিজ হলে মস্তিষ্ক ডোপামিনের ব্যাপারে সংবেদনশীল হয়ে যায়।ফলে আগের মতো আর কাজ হয় না।

মাদকদ্রব্যের মতো পর্ণও খুব সহজেই মস্তিষ্কে ডোপামিনের বন্যা বইয়ে দিয়ে দর্শককে ক্ষণিকের জন্য আনন্দ দিতে পারে। পর্ণ আসক্ত আর মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা গিয়েছে, তাদের মস্তিষ্কের গঠন হুবহু এক। ডোপামিন ব্রেইন পালসের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুরষ্কার পাবার নতুন রাস্তা তৈরি করে। যার ফলে যে কাজটার কারণে প্রথমবার ডোপামিন নির্গত হয়েছিলো, মস্তিষ্ক ডোপামিনের লোভে বার বার সেটাকে ফিরে যেতে চায়।

এই কারণে একবার আসক্তি হলে বার বার আসক্তিতে পরিণতি হয়।আর এইজন্য, মাদকাসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি এবং অন্যান্য বিষয় উপর আসক্তি লৌবের মারাত্মক ক্ষতি করে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো- একজন মানুষ যত বেশি আসক্তি হবে,তার মস্তিষ্কে তত বেশি ক্ষতি হতে থাকে এবং ক্ষতিপূরণ থেকে ফিরে আসাটা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।।।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *