দুর্নীতি মুক্তির পরশ পাথর: পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নাকি সঠিক পদায়ন

দুর্নীতি মুক্তির পরশ পাথর: পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নাকি সঠিক পদায়ন

শেখ মাহাতাবউদ্দিন


সাম্প্রতিক সময়ের খবর এবং মানুষের মুখরোচক সমালোচনার অন্যতম বিষয় হল চিহ্নিত পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি। বিশেষ করে টেকনাফ থানার শামলাপুর তল্লাশিচৌকির নিকটে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানের মৃত্যুতে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশের সম্পৃক্ততা এই আলোচনাকে অনেক রসদ যুগিয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ মনে করছেন।

প্রদীপ কুমার দাশ গ্রেপ্তারের পর থেকেই একে একে বেড়িয়ে আসছে তার বিভিন্ন অপকর্মের ফিরিস্তি। রিতিমত তাজ্জব বনে যাওয়ার মত রেকর্ড তার, যার অন্যতম হল, ২০১৮ সালের মে থেকে২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারে “বন্দুকযুদ্ধ” বা “ক্রসফায়ারে” নিহত হয়েছেন মোট ২৮৭ জন, তাদের মধ্যে ১৬১ জনই মারা গেছে টেকনাফ থানা পুলিশের হাতে।

প্রশ্ন হল তাহলে কি কেবল কক্সবাজারেই এমন ঘটনা হয়েছে? উত্তর না, প্রথম আলো পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত এমন ভাবে নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৮৫০ জন। হ্যা, ১৩ আগস্ট 2020 পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ মৃতের তুলনাতে এই সংখ্যাটি মাত্র ৬৬৩ জন কম, অর্থাৎ জন জীবনে এই ঘটনার গুরুত্ব মহামারীর কাছাকাছি।

সে যাই হোক, টেকনাফ থানার এই মৃত্যুর মিছিলের অধিকাংশগুলো নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। একই সাথে প্রদীপ কুমার দাশের অনৈতিক এবং অসংলগ্ন কর্মকাণ্ডেরও অগণিত অভিযোগ প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন গনমাধ্যম গুলোতে।

শুধু যে প্রদীপ কুমার দাশকে নিয়েই এমন লোমহর্ষক ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে আসছে কিংবা প্রদীপ কুমার দাশই প্রথম ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যার সম্পর্কে এমন রিপোর্ট তা কিন্তু নয়। কিছু দিন পূর্বের সংবাদ পত্রগুলো ঘাঁটলেই দেখব বরগুনার আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষেই মিলেছে এক আসামীর ঝুলন্ত লাশ।

এমন বহু প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনার নায়ক হিসেবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নাম আসে পত্রিকার পাতাতে। তার মানে কি পুলিশ বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মানেই অঘটন ঘটন পটীয়সী? উত্তর অবশ্যই না হবে, কারন এর উত্তর সর্বদা হ্যা হলে আমরা কেউই শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম না। তবে যে হারে একেকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নামে রিপোর্ট হচ্ছে সেটাও আশংকাজনক।

বর্তমানে প্রচলিত নিয়মে মাননীয় সাংসদগণের ডিও লেটারের মাধ্যমে অনেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়ন হয়। একই সাথে একজন কনস্টেবল বা এ এস আই থেকে পদোন্নতি পেয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হচ্ছেন। সময়ের সাথে সাথে উপরস্থ অসৎ সহকর্মীদের বিভিন্ন অন্যায় এবং সিস্টেমের ফাঁক ফোঁকরে লুকিয়ে থাকা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এদের নৈতিকতার কফিনে শেষ পেরেক বিদ্ধ হওয়া ঠেকানো এদের জন্য দুস্কর নয় বরং অসম্ভবই হয়ে পরে। ফলাফল, তড়িৎ আবেশের মত অসততার আবেশ যুক্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

এই অসততার আবেশ এবং প্রদীপের নিচের অন্ধকারকে মশালের আলোকবর্তিকার আলতে ঝলমলে করতে ৪ বছর পূর্বেই এক অবিসংবাদিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে গনমাধ্যম মারফত জেনে ছিলাম। এই সিদ্ধান্ত শুনেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়কে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম আমরা রাষ্ট্রের সাধারণ এবং সচেতন জনগণ।

সিদ্ধান্তটি ছিল, সরাসরি বিসিএস থেকে অর্থাৎ সহকারী এস পি দের প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা, যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পদায়ন করা হবে। একজন সদ্যজাত সন্তানের যেমন অপরাধ প্রবণতা শূন্যের কোঁটাতে তেমনি একজন সদ্য সারদার ট্রেনিং এবং আনুসাঙ্গিক প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা শেষ করা পুলিশ অফিসারেরও গায়ে কাঁদা মেখে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার ইচ্ছাও থাকবে সর্বনিম্ন লেভেলের।

ফলশ্রুতিতে থানার পূর্বোক্ত পুলিশের সদস্যদের মধ্যে অনৈতিক কিংবা অসৎ কেউ থাকলে তার অসততাকেও লাগাম টেনে ধরতে পারবেন সহজেই। এই প্রয়াস অন্তত কোন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রদীপ কুমার দাশ হতে দিবে না বলেই অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন জনগণের বিশ্বাস। বাধা হিসেবে বলতে পারেন সদ্য নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার অভাবের বিষয়টি, এই ক্ষেত্রে বলব, সকল কাজের জন্য অভিজ্ঞতা ভালো কোন গুন না।

অপরদিকে, থানা সদরের প্রায় সকল সরকারি দপ্তর পরিচালিত হয় একজন বিসিএস ক্যাডার কিংবা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে শুধুমাত্র এই থানার দেওয়াল গুলো বাদে। যদি একজন বি সি এস কর্মকর্তা অন্য দপ্তরগুলো সুচারুরূপে পরিচালনা করতে পারেন তবে সারদার ট্রেনিং এবং আনুসাঙ্গিক প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা এর পরে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও নিজের অধিনস্তদের সহযোগিতা নিয়েই একেকটি থানাকে জনগণের ভয়ের স্থল থেকে মুক্ত করে জনবান্ধব এবং জননিরাপত্তার আধার হিসেবে গড়ে তুলবেন বলেই সচেতন জনগণ বিশ্বাস করতে চায়।

পরিশেষে রাষ্ট্রের সচেতন জনগণের পক্ষ থেকে এবং একজন মেরুদণ্ড গঠনের কারিগর হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট আবেদন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা থানাকে দুর্নীতি মুক্ত করতে প্রতিটি থানাতে একজন বিসিএস কর্মকর্তা নিয়োগ দিন।

বাংলাদেশ পুলিশের মত দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গঠনকারী একটি বাহিনীকে অসাধু কর্মকর্তাদের করা অনৈতিক কাজের ভার মুক্ত করুন, যার অন্যতম হাতিয়ার হবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সৎ, চৌকশ এবং মেধাবী বিসিএস ক্যাডারদের নিয়োগ।

শেখ মাহাতাবউদ্দিন, পিএইচ. ডি.
সহযোগী অধ্যাপক, পুষ্টি এবং খাদ্য প্রকৌশল বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *