দেশ আমার, দোষ আমার

দেশ আমার, দোষ আমার

নাজমুস সাবাহ কুবরা


বাংলাদেশ আজ হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্বাধীনতার ৪৮ বছর উদযাপন করছে। এই স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালী জাতিকে যে পরিমাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, তা অন্য কোন জাতিকে দিতে হয়নি। বাঙালী জাতির ইতিহাসটাও সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো আমাদের রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনেরও আগের সময় গুলোতে ফিরে তাকালে আমরা বাঙালী জাতির নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতাবোধ দেখতে পাই। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালী জাতির সংগ্রামের শুরু হয়,যা পরবর্তীতে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেয়। ৫২’র ভাষা আন্দোলন হয় মূলত বাঙালী জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতাবোধ থেকে। বাঙালী নিজ সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি কতটা সচেতন তা ৫২’তে রফিক,বরকত,শফিক তাদের আত্মাত্যাগের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে। যা সত্যিই আমাদের জন্য গর্ব ও শিক্ষা অর্জনের বিষয়।

৫২’র ভাষা আন্দোলনের সকল শহীদদের থেকে শুরু করে ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০’এর নির্বাচন, ৭১’এর মহান মুক্তিযুদ্ধ সবই বাঙালী জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতা ও দেশপ্রেমেরই স্বরূপ।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি নিজ ভাষা তাঁর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানের বিষয়। যা আমাদের জন্য নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রেরণা স্বরুপ। অথচ আজকাল অর্থব্যয় হয় ঠিকই কিন্তু সেই চেতনাবোধের উদয় নেই আমাদের মাঝে। তাই এসব জাতীয় দিবস উদযাপন এক পর্যায়ের দেশপ্রেমের নামে প্রহসনে পরিণত হয়েছে।


কিন্তু এতকিছুর পরেও, আজ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে দাঁড়িয়ে জাতির কাছে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে যায়। আর সেটা হলো,এই বর্তমানে দাড়িয়ে আমরা কি আদৌও সেই দেশপ্রেম, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতাবোধ ধরে রাখতে পেরেছি? নাকি ধসে পরা জাতির মতো অন্যের ভাষা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে মত্ত আমরা। আজ পুরো দেশ জুড়েই চলছে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা ও অবমাননা।

বাঙালী উৎসবমুখর। সারাবছর নানা পূজা,পার্বণে মুখর থাকে আর এসব আয়োজনে আজকাল দেখা যায় বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। দেশীয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলো দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র, কিন্তু আজকাল সেখানেই ভূলুন্ঠিত দেশীয় সংস্কৃতি। এসব প্রতিষ্ঠানে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় সেখানেই দেখা যায় ভারতীয় বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র‍্যাগ ডে পালন করা হয় অনেক জাঁকজমকভাবে, যা থাকে নাচে গানে ভরপুর। আর এসব এর বেশিরভাগটাই জুড়ে ভারতীয় বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সব গান। যেখানে কোন দেশীয় গান বাজানোর কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জাতির কর্ণধার, পরবর্তীতে দেশ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব এদেরই ওপর, তাই তাদেরই বেশী সচেতন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ তারাই উদাসীন, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।

আমাদের দেশ সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, আমাদের রয়েছে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি,পালাগানসহ কবিতা, ছড়া, নাটক, গল্প, ও আরও নানান কিছু। তাই ভিনদেশি সংস্কৃতির কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। জাতীয় দিবস যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি দিবসগুলো অনেক জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়, যার জন্য প্রচুর অর্থব্যয়ও করতে হয়। কিন্তু দেখা যায় সকালের দেশপ্রেম বিকেলে কোন বিদেশী সংস্কৃতির আদলে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি নিজ ভাষা তাঁর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানের বিষয়। যা আমাদের জন্য নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রেরণা স্বরুপ। অথচ আজকাল অর্থব্যয় হয় ঠিকই কিন্তু সেই চেতনাবোধের উদয় নেই আমাদের মাঝে। তাই এসব জাতীয় দিবস উদযাপন এক পর্যায়ের দেশপ্রেমের নামে প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

এভাবে চলতে থাকলে একসময় আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ভুলে বিপথগামী হয়ে পড়বো আর এ দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। এ দায় আপনার, আমার, আমাদের সকলের। তাই আমাদের সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরী। দেশ আমাদের তাই সচেতনতার দায়িত্বও আমাদের।

পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুস্থ,সুন্দর সংস্কৃতিক উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের। এখনি তার মোক্ষম সময়। যে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের শুরুই হয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতা থেকে, সে জাতির মহান দায়িত্ব সেই ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা ও তার চর্চা করা।


লেখক: ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।


সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *