পথের ফুল

পথের ফুল

রুদ্র ইকবাল


মায়ের ডকে ঘুমটা ভেঙে গেল। জবুথুবু হয়ে বসে রইল সাজিদ। মনে একরাশ হতাশা নিয়ে নিশ্বাস ফেলল, ভার্সিটির ছুটি শেষ ফিরতে হবে আবার মা বাবা, ছোটভাই বোনকে ছেড়ে আবার ফিরতে হবে কোলাহলময় শহরে।

গ্রমের বন্ধু, রাতের বেলা পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়ানো, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গ্রামের চায়ের টং-এ আড্ডা দাদু দাদীর সাথে আড্ডা খুনসুটি এসব মনে করতে করতে কোন এক হতাশার মধ্যে ডুবে গেছিল। মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সাজিদ। রাতেই সব কিছু গুছিয়ে নেই।

সকালে ট্রেন। মায়ের হাতের পিঠা আর সকালের খাবার সেরে, মা’কে সালাম করে ছোট ভাই বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সাজিদ। সকালের ট্রেনধরতে হবে।রেলস্টেশনের দিকে ছাড়া বাসে বসে থাকল সাজিদ। গ্রামের সব স্মৃতি যেন তাকে ঘিরেই ধরল। রেলস্টেশনে পৌছে আনমনা হয়ে ট্রেনের জন্য বসে রইল।

হটাৎ কোন এক চিৎকার চেচামেচিতে ঘোর কাটল সাজিদের। দূর থেকে দেখে আচ করা যায় চায়ের টং-এ এক ছেলেকে মারতেছে। এগিয়ে গেল সাজিদ। দোকানদার থেকে জিজ্ঞেস করল,
মারতেছেন কেন?
-ছেলেটা রুটি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল।
তাই বলে এইভাবে মারবেন?
-ওদেরকে মারা দরকার, সাহসটা বেড়ে যায় না মারলে।
রুটির টাকা দিয়ে সাজিদ ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল এক জায়গায়।

সাজিদ ছেলেটার দিকে ভাল করে দেখল। চুল গুলো কোকড়ানো, গায়ে একটা ছিড়া গেঞ্জি আর প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। বয়সটা ১০-১১ এর বেশি হবে না।
সাজিদ জিজ্ঞেস করল চুরি করতেছিলা কেন?
ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে দেখে রইল সাজিদের দিকে।
কি হল? তাকিয়ে আছ কেন?
-ভাই আপনি ছাড়া আর কেউ তুমি করে কেউ কথা বলেনি।
আচ্ছা বলো। চুরি করতেছিলা কেন?
– গতকাল সকালে খেয়েছিলাম, গতকাল সারাদিন কোন কাজ পায়নি। এখনো ছোট তাই কেউ কাজ দিতে চাই না।
কিসের কাজ করো?
-কুলি।

কথাটা শুনে সাজিদ খুব ব্যথিত হল। এখনো ১০-১১ বছর আর ও কুলির কাজ করে। ঘরে কোন ভারি কাজ করলে মা’য়ের হাতের লেবুর শরবত আরো কত কি! আর ওরা কাজ করে পেটের দায়ে।
নাম কি তোমার?
-রনি।
খুব সুন্দর নাম।
মলিনময় মুখটা পিক করে হেসে দিল। হাসিতে কোন এক মায়া লুকিয়ে আছে।
তোমার আর কে কে আছে?
-আমার কেউ নেই। মা-বাবা কি জিনিস জানি না।

রনিকে নিয়ে পাশের এক রেস্তোরায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম।
রনির সাথে চলতেছে এক ভালবাসার আড্ডা। ঘড়ির দিকে দেখে বুঝতে পারল ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। সাজিদ কিছুক্ষণ চিন্তা করে ট্রেন টা মিস দিল। সকাল গড়িয়ে দুপুর। শুনতে থাকল রনির মুখে জীবন সংগ্রামের কথা। সাজিদ
থমকে যায়। এই ২০ বছরের জীবনে সে ১০ বছরের রনির সামান্যতম জীবন সংগ্রামে অংশ নিতে হয়নি।

রনির সাথে সকাল থেকে সন্ধ্যা ঘুরে বেড়ানো আড্ডা খাওয়া দাওয়া সব মিলিয়ে সাজিদের জীবনে এক সোনালী দিন গেল। সন্ধ্যার ট্রেন ধরতে হবে। রায়হানের সাথে সন্ধ্যার নাস্তা সেরে নিয়ে বিদায় নিবে, এই সময় রনি বলল,
– একটা কথা বলব?
বলো।
আপনাকে ভাই ডাকতে পারি?

সাজিদের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। অবশ্যই ডাকবা। আজ থেকে তুমি আমার ভাই কিছুদূর যাওয়ার পর সাজিদ চিন্তা করল, এখন তো শীতকাল। আর রনির গায়ে একটা গেঞ্জি আর প্যান্ট ছাড়া তো আর কিছুই নেই। পিছনে ফিরে আবার রনির কাছে যায়। মায়ের দেওয়া শাল টা রনির গায়ে মুড়িয়ে দিল সাজিদ আর হাতে অল্প কিছু টাকা মুড়িয়ে দিয়ে বলল
কখনো চুরি করবা না।

রনি শেষমেশ বুকে এসে বলল
-আপনার মত ভাল ব্যবহার কেউ কখনো করেনি।
রনি, আমি আগামী মাসে আবার আসব তোমাকে যেন এখানেই দেখতে পাই।

সাজিদ ট্রেনে উঠার আগ পর্যন্ত রনি আনমনে সাজিদের দিকে দেখে থাকল। ট্রেনে উঠে গ্রামের কথা ভুলে রনির কথা ভাবতে রইল। আবার আসতে হবে এই রেলস্টেশনে রনির জন্য।

লেখক ও শিক্ষার্থী
রুদ্র ইকবাল

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *