পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে এতো গড়িমসি কেন?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে এতো গড়িমসি কেন?

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা আটকে আছে শিক্ষার্থীদের । বিগত ৮ মাস ধরে ঝুলে রয়েছে এসব চূড়ান্ত পরীক্ষা। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা আটকে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে উচ্চ শিক্ষাসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগদান করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। তাদের পক্ষে একটা বছর বসে নষ্ট হওয়া মানে বিরাট ক্ষতি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারবে, পরীক্ষা দিতে পারবে, পরবর্তী সেমিস্টারে উন্নীত হতে পারবে, ভর্তি কার্যক্রম চালাতে পারবে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সারা বিশ্বের সব দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনলাইনেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেই পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর জন্য তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। অন্যদিকে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় নয় লাখ ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তা ভাগ্যের হাতে ঠেলে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে কখন করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসবে তার জন্য।

আর একটি আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত বাকি সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখতে পেলাম না তারা লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট করেছে বা অন্য কোথায় হতে সফটওয়ার ক্রয় করেছে। প্রকৃতপক্ষে অনেকই ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে গাল-গল্প জোরালোভাবে সেমিনারে বললেও কাগজে কলমে এনালগ পদ্ধতিতে চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেশনজট কমানোর বা দূরীকরণের পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ভেবে থাকে যে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমলে বা চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে সেশনজটসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করবে-এটি অনেকেক্ষেত্রে বাস্তবতার বাইরের বিষয়।

সাম্প্রতিককালে দেখা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটাই যদি হয় তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বর্তমান অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফাইনাল নিতে সমস্যা কোথায়? সামাজিক যোগাযোগের কল্যাণে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা লিখেছে দেখলাম, “ভর্তি পরীক্ষায় কোটি কোটি টাকা পাবে তাই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আগ্রহী। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আগ্রহ নেই।”

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউয়ুম কাফি নামের একজন শিক্ষার্থী আমাকে বললও, ”গত ২ সেমিস্টারের সকল পরীক্ষা বাকি আছে। এভাবে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ছাড়া চলতে থাকলে আগামী বছর পরীক্ষা দিতে দিতে সকল সময় চলে যাবে। ছাত্রটি আমাকে প্রশ্ন করলো স্যার একজন ছাত্র যদি তৃতীয় বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে ৪র্থ বর্ষে সকল ক্লাস শেষ করে দেখা গেল, তৃতীয় বর্ষে কোন কারনে ফেইল করলে তার দায়িত্ব কে নিবে? সে আরও বললো শিক্ষার্থীরা একসাথে অনেকগুলো পরীক্ষা দিতে গিয়ে খারাপ করতে পারে সেটিও কেউ ভেবে দেখছে না।”

দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নিচ্ছে আর কোন কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হাত গুটিয়ে করোনার অজুহাত দিচ্ছে। আমার একজন শিক্ষক আমাকে বলেছিলো পৃথিবীর সকল মানুষের হাত ২টি আর বাঙালির হাত ১টি বেশি সেটি হলো অজুহাত। এই কথাটি বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই যথোপযোগী কথা সেটি টের পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকটি পাবলিক সংবাদপত্রে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার জন্য মানববন্ধনও করলো এবং শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল লোকের পরীক্ষার বিষয়ে বললে করছি, করবো, দেখছি, দেখেবো বলে কাজে বিলম্বে ঘটায়। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? সত্যিই বলতে কী শামসুর রাহমানের কবিতার মতো-উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।

আমার একজন সহকর্মী রাগ করে বললেন,“পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যদি সদিচ্ছা থাকতো তাহলে তারাতো ভর্তি পরীক্ষার মতো শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা আগেই নিতে পারতো। ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সময় মনে হচ্ছে শিক্ষা সেক্টরে কোন করোনা নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার সময় মনে হচ্ছে করোনা অনেক প্রভাব বিস্তার করেছে।”

আশা করছি, শিক্ষার্থীদের ক্ষতির কথা মাথায় রেখে হলে কমসংখ্যক শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি বর্ষের শিক্ষার্থীদের সময় ভাগ করে ভর্তির পরীক্ষার মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরাসরি সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ জরুরি বিষয় বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *