ফ্যামিলি সিন্ডিকেটে নিয়োগ বাণিজ্যে ভরপুর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

ফ্যামিলি সিন্ডিকেটে নিয়োগ বাণিজ্যে ভরপুর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

কামরুল হাসান মামুন


পত্রিকা মারফত জানা যাচ্ছে যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার মালেক তার মেয়েকে অফিস সহকারী পদে, ভাইকে অফিস সহায়ক পদে, ভাতিজাকে অফিস সহায়ক পদে, বড় মেয়ের স্বামীকে ক্যান্টিন ম্যানেজার হিসেবে, ভাগ্নেকে ড্রাইভার পদে, ভায়রাকে ড্রাইভার পদে ছাড়া এক নিকট আত্মীয়কে অফিস সহায়ক পদে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাকরি দিয়েছেন।’

যেই অফিসে এতজন তার নিজস্ব লোক থাকবে সেই অফিসে তার ক্ষমতা বুঝতে পারছেন? অর্থাৎ যত বেশি আত্মীয় পরিজনকে চাকুরী দিয়েছে ততবেশি সে ক্ষমতাবান হয়েছে।

এইরকম ঘটনা কি কেবল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেই ঘটেছে? ইন ফ্যাক্ট, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই এরকম বউ-শালা-শালী আর মামা-ভাগ্নে-দুলাভাই দিয়ে ভরে গেছে।

খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই এইরকম ঘটনায় ভরপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্কুল আছে। নাম তার ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল। কেন “ল্যাবরেটরি” শব্দটি আছে? কারণ এটি ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশন এন্ড রিসার্চ এর একটি গবেষণাগার। সঙ্গত কারণেই এটি একটি মডেল স্কুল হওয়ার কথা। বাংলাদেশের সেরা স্কুল হওয়ার কথা। একসময় মন্দ ছিল না।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক আছে যারা এখান থেকে পাশ করেছে। কিন্তু এখন আর আগের মত নাই। এখন এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ স্কুলগুলির মধ্যে একটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকের ছেলেমেয়ে এখন আর ওখানে পড়ে না। কিভাবে এত খারাপ হলো? ঠিক যখন থেকে ভিসিদের মাধ্যমে দলীয় শিক্ষকদের বৌ, শালীদের চাকুরী দেওয়া শুরু করল সেইদিন থেকেই ধস নামা শুরু করে আজকে তলানিতে এসে ঠেকেছে।

অথচ এইরকম একটি জায়গায়, IER-এর মত খ্যাতিমান একটি ইনস্টিটিউটের তত্বাবধানে থাকার পরও নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গল্পই প্রায় একই রকম। আমরা অনেক কিছুই শুরু করি ভালোভাবে তারপর নষ্ট করি একইভাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্পও একই। এটিও শুরু হয়েছিল অসম্ভব সম্ভবনা দেখিয়ে। চলছিল বেশ। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর যেদিন থেকে আমরা নিজেরা এটি পরিচালনার পূর্ন অধিকার পেলাম সেদিন থেকে এটির ধস দিনকে দিন কেবল ত্বরান্বিত হয়েছে। শিক্ষকের ছেলে বা মেয়ে বলে এক্সট্রা খাতির, দলের ছাত্র বলে এক্সট্রা খাতির দিয়ে শুধু শিক্ষক নিয়োগই না কর্মকর্তা আর কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে বিরামহীনভাবে।

কিছুদিন আগে এক কর্মকর্তা যে এই করোনা কালে নকল মাস্ক সাপ্লাই দিয়ে এখন জেলে গেল সে কিভাবে চাকুরী পেল। সে চাকুরী পেয়েছে কারণ সে ছিল ছাত্রলীগ নেত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রেও আমরা কোটা সিস্টেম চালু করেছি। এইটাও এক ধরণের স্বজনপ্রীতি যার মাধ্যমে মেধাকে compromise করা হয়।

এই রেজিস্ট্রার ভবন ভরে গেছে দলের লোক আর আত্মীয়দের নিয়োগ দিয়ে। একটা প্রতিষ্ঠান কত নিতে পারে। এত অন্যায় হয়েছে এবং হচ্ছে এটি ভালো থাকবে কিভাবে? কোন এক কর্মচারী বা কর্মকর্তা মারা গেলে তার স্ত্রী বা সন্তানদের চাকুরী দেওয়া এখন একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে যদি মেধাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দেওয়া হয় এটি ভালো থাকতে পারে না।

ক্ষমতাবান থিসিস সুপার ভাইসর হলে কেবল নিজের থিসিস ছাত্রকেই শিক্ষক বানানো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে চলছেই। এরা ছাত্রদের নীতি নৈতিকতাকেও কলুষিত করে। এই শিক্ষকদের কি আপনি শিক্ষক বলবেন? এরা রীতিমত দেশের শত্রু।

এসব করতে করতে কোয়ালিটি কম্প্রমাইজ ও নিয়োগ বাণিজ্যও হচ্ছে। তার থেকে বড় কথা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটা ফ্যামিলি সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে। এইভাবেই আমরা আমাদের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে ফেলছি। বড় পর্দায় দেখলে এর ফলে আমরা আমাদের দেশটিকেই আসলে নষ্ট করে ফেলছি। সমস্ত প্রতিষ্ঠানে কোন না কোন সিন্ডিকেট একটিভ।

লেখক

কামরুল হাসান মামুন,

অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *