বঙ্গবন্ধুর একক ৬ দফা, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও স্বাধীন বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধুর একক ৬ দফা, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও স্বাধীন বাংলাদেশ

মোঃ মেজবাহুল ইসলাম


১৯৪৭ সালে ভারত -পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়ার কিছুদিন পরই যখন পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ ও নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি মোহে আচ্ছন্ন তখন কলকাতার বেকার হোস্টেলে জনপ্রিয় তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সতীর্থ ও সহযোদ্ধাদের নিয়ে এক ছোট্র সভায় বললেন, পাকিস্তানিরা বাঙ্গালীর স্বার্থরক্ষা করবে না।তাই মাওড়াদের সাথে বেশিদিন থাকা যাবেনা।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের কারণেই গঠন করলেন ছাত্রলীগ,আওয়ামী লীগ।১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনেও স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুললেন এবং ২১ দফার অন্যতম দফা হিসেবে চিহ্নিত করলেন।সময়ের সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৬১ সালে ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কমরেড মণি সিং ও কমরেড ফরহাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর এক গোপন বৈঠকের আয়োজন করেন।

বৈঠকে শেখ মুজিব তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হননি কমরেডদের কাছে স্বাধীনতার বিষয়ে তাদের মন্তব্য জানতে চাইলে তারা বলেন এ মুহুর্তে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সঠিক হবেনা বলে শেখ মুজিবকে সর্তক করেন।শেখ মুজিবও বৈঠকের শেষে বলেন-“স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোস করব না।এভাবেই কোন নির্দিষ্ট লক্ষ না নিয়েই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সামরিক জান্তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন।

১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়।এসময় বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত।এই ১৭ দিনের যুদ্ধের সময়ে পূর্ব বাংলাকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে পাক সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন।

চীনের ভয়ে ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি, পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই হাস্যকর যুক্তির অবতারণা বঙ্গবন্ধু বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানকে ১৭ দিন যুদ্ধকালীন সময়ে এতিমের মত ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত লেফট রাইট করে হেঁটে যেত তবুও তাদেরকে বাধা দেয়ার মত অস্ত্র বা লোকবল কিছুই পূর্ব বাংলার ছিল না। আর চীনই যদি আমাদের রক্ষাকর্তা হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে চীনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেই হয়।”

পাকিস্তানের আইয়ুব সরকারে বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষে সমগ্র পাকিস্তানের বিরোধী দল সমূহে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারিতে এক কনভেনশন আয়োজন করে।শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে ১০ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল কনভেনশনে যোগ দেন এবং শেখ মুজিব সেখানে বাঙ্গালীর মুক্তি সনদ ৬ দফা পেশ করলে সভায় হট্টগোল সৃষ্টি হয় এবং শেখ মুজিবুরের ৬ দফা সভার আলোচ্যসূচিতে না থাকায় প্রতিবাদস্বরুপ শেখ মুজিব সভাস্থল ত্যাগ করেন।

১১ ফেব্রুয়ারী লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে এক অনির্ধারিত সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ব্যাখ্যা প্রদান করে ও ৬ দফার দাবিকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বলে আখ্যায়িত করেন।

পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠী, পাকিস্তানভিত্তিক দলসমূহ এমনকি আওয়ামী লীগের বিরাট একটি অংশ ছয় দফাকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ও শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ২০ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় শেখ মুজিব এক প্রকার জোর করেই ছয় দফাকে পাশ করান। ১৯৬৬ সালের ১৮,১৯,২০ মার্চের আওয়ামী লীগের সন্মেলন ১৪৪৩ জন কাউন্সিলরের ভোটে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরী সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং শেখ মুজিব সেদিনই আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত করেন।

৬ দফা নিয়ে পূর্ব বাংলায়,সাড়া পড়লে আইয়ুব খান বলেন -৬ দফা নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া হবে।মজলুম জননেতা মাওলানা হামিদ খান ভাসানী ৬ দফাকে সি.আই.এর দলিল হিসেবে অভিহিত করেন।গোলাম আযমের জামায়াতী ইসলামের নেতৃত্বে পাকিস্তানপন্থী ৮ টি দলের সমন্বয়ে পিডিএম নামক একটি জোট তৈরি করে ৮ দফা প্রণয়ন করে ৬দফার বিরুদ্ধে। ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ৬দফা সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেন “আরে মিয়া বুঝো না,দফাতো একটাই একটু ঘুরাইয়া কইলাম শুধু।

তৎকালীন বিবিসি সাংবাদিক সৈয়দ শামসুল হক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ৬দফা নিয়ে প্রশ্ন করলে বঙ্গবন্ধু জবাব দেন- দফা ৬টা না দফা হল ৩টা কত নোছো,কত দেবা,কবে যাবা।

এছাড়া তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ডাক না দিয়ে ৬ দফা কেন দিলেন জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেন-” স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার সাঁকো করে দিলাম।”৬ দফার আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু আতাউর রহমান খানসহ অনেক নেতার কাছে যান কিন্তু সবাই ফাঁসির ভয়ে আন্দোলনে যুক্ত হননি।বঙ্গবন্ধু তখন বলেন যদি একাই রাজপথে লড়াই করতে হয় করব তবুও ৬ দফার প্রশ্নে কোন আপোস করবনা। ভবিষ্যতে ইতিহাসই প্রমাণ করবে ৬ দফাই একমাত্র বাঙ্গালীর মুক্তির পথ।এলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ৬ দফার আবেদন সৃষ্টির জন্য জেলা পর্যায়ে জনসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সালের ৭ই এপ্রিল পাবনা জেলার মধ্যদিয়ে ৬ দফার বিষয়ে জনসভা শুরু করে।

মোট ৩২ দিনে ৩৫টি জনসভায়,বঙ্গবন্ধু ৬দফার বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন এবং জনগণও ব্যাপক সাড়া দেয়। এরফলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় দেশরক্ষা আইনে মামলা করতে থাকেন।

১৯৬৬ সালের ৮ই মে মে দিবস উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ পর চাষাঢ়ায় জনসভা থেকে ফেরত আসার পথে দেশরক্ষা আইনের ৩২(১) এর “ক” ধারায় আটক করেন এবং বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে শুরুতে পান যা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে একটানা সর্বোচ্চ জেল। ৮ই মে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সাতই জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। সাতই জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা যেন অগ্নিগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ সেদিন স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।

প্রকৃতপক্ষে সাতই জুন ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রা বিন্দু। ৬৬ এর দফার কারণেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয় ফলে গণঅভ্যুত্থান হয় ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পায় ও আইয়ুব খানের পতন হয় এবং জেনারেল ইয়াহিয়া নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ৭০এর নির্বাচনের ফলেই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

বঙ্গবন্ধু ৫ই ফেব্রুয়ারিতে ৬ দফা ঘোষণা করলেও ৭ই জুন ৬ দফা দিবস পালন কেন করা হয় এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৭২ সালের ৭ই জুন দৈনিক বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন-তাজউদ্দীন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন “জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এগোয় সর্পিল গতিতে। আঁকাবাঁকা পথ ধরে। রক্ত পিচ্ছিল এই পথ। বাধা এখানে অসংখ্য। পার হতে হয় অনেক চড়াই উৎরাই। সংগ্রামের এক একটা মোড় পরিবর্তনে ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়।

৭ জুন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এমনি একটি যুগান্তকারী মোড় পরিবর্তন। ৭ জুনকে এক অর্থে বলা যায় ৬ দফার দিবস। এই দিনে ৬ দফার দাবিতে বাঙ্গালী রক্ত দিতে শুরু করে। স্বাধিকারের এই আন্দোলনই ধাপে ধাপে রক্তনদী পেরিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়েছে। কাজেই বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে ৭ জুন অমর। অবিস্মরণীয় এক ঐতিহাসিক দিন ৭ জুন।

১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সর্বাত্মক হরতালে শহীদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।


লেখকঃ মোঃমেজবাহুল ইসলাম
সহ-সভাপতি,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *