বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও রক্তস্নাত আগস্ট

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও রক্তস্নাত আগস্ট

অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা


১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট নয়টার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণভবন থেকে নিজ বাসভবন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে ফিরে আসেন। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। শেখ রাসেল তার পিতাকে অনেকের সাথে ফুল দিবে।

এ নিয়ে তার ভীষণ আনন্দ। রাত ৯টার পর তোফায়েল আহমেদ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বঙ্গবন্ধু সাধারণত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে ঘুমাতে যেতেন। প্রতিদিনের মত সেদিন রাতে তোফায়েল আহমেদদের বিদায় দিয়ে তিনি ঘুমাতে যান।

বঙ্গবন্ধুর বাসায় থাকতেন তাঁর পিএ জনাব মহিতুল ইসলাম। জনাব ইসলাম সেদিন রাতে দেড়টার দিকে ঘুমাতে যান। শেষ রাতের দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসার একজন কাজের লোক জনাব মহিতুল ইসলামকে ডেকে বলেন বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে কথা বলবেন। জনাব ইসলাম টেলিফোন ধরলে বঙ্গবন্ধু সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণ হয়েছে বলে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে বলেন।

বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় নিচে নেমে আসেন। মহিতুল ইসলামের টেলিফোন পুলিশ কন্ট্রোল রুম রিসিভ করেনি এবং বঙ্গভবনের এক্সচেঞ্জে রিং হয়েছে কিন্তু কোন উত্তর পাননি। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে বলতে থাকেন ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি … ’ বলতে বলতেই পিছনের জানালায় গুলিবৃষ্টি শুরু হয়। জনাব ইসলামের হাত রক্তাক্ত হয়ে যায়- বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়তে বলেন তাকে ইশারায়।

বঙ্গবন্ধুর বাসার কাজের ছেলে আবদুল পাঞ্জাবি এবং চশমা নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু সেখানে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি পরেন এবং এরপর উপরে উঠে যান। কিছুক্ষণ পর শেখ কামাল নিচে নেমে আসেন। শেখ কামাল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিছুদিন পূর্বে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি এ্যাথলেট সুলতানা পারভীন-কে বিয়ে করেন। হাতের মেহেদী তখনও শুকায়নি।
শেখ কামাল নিচে আসার পরই একজন কালো পোশাকধারী কামালের পায়ে গুলি করে।

পরবর্তীতে কালো পোশাকধারীরা শেখ কামালকে ব্রাশ ফায়ার করলে তাঁর বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এরপর ঘাতকরা উপরে উঠে যায়। মহিতুল সাহেবরা গোলাগুলির শব্দ পায় এবং বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরও শুনতে পায়। বঙ্গবন্ধু জানতে চান তাকে কোথায় যেতে হবে। প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করার সাহস পায়নি। পরবর্তীতে প্রচণ্ড ব্রাশফায়ারের শব্দ শোনা যায়।

কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে আসে দোতলায়। কিছুক্ষণ পর মেয়েদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় নিচতলা থেকে। পালাক্রমে কান্না এবং গুলির শব্দ শোনা যায়। বেশ কিছুক্ষণ সময় এভাবে গুলি এবং কান্নার শব্দ শোনা যায়- তারপর এক সময় কান্নার আওয়াজ থেমে যায়। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই শেখ নাসেরকে নিচে নামানো হয়। নিচে অফিসের পাশে বাথরুমে নিয়ে তাঁকে গুলি করা হয়।

কিছুক্ষণ পর শেখ নাসেরের কণ্ঠে ‘পানি, পানি’ বলে আর্তনাদ শোনা যায়। পূর্বের সেই ঘাতক পানির পরিবর্তে তাঁকে পুনরায় গুলি করে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সে মুহূর্তে বাকি আছে ছোট্ট রাসেল। রাসেলকে নিচে নামিয়ে আনে। ছোট্ট রাসেল মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে- আর জিজ্ঞাস করে ওরাতো আমাকে মেরে ফেলবে না? আমি আর কোনদিন এ বাড়িতে আসবো না।

পরে একজন ঘাতক শেখ রাসেলকে প্রধান গেটের কাছে পুলিশ বাঙ্কারে আটকে রাখে। রাসেল মা মা বলে কাঁদতে থাকে এবং বলতে থাকে আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও। এরপর রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপরে নিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ পাওয়া যায়। জনাব মহিতুল ইসলাম বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধুর সেই আদরের ছোট্ট ছেলেটি আর নেই।

সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য ছুটে আসেন কর্ণেল জামিল। তাঁকে হত্যা করা হয় সোবহানবাগ মসজিদের কাছে এবং তাঁর মৃতদেহ তাঁর গাড়িতে রাখা হয়েছিলো। রক্তাক্ত অবস্থায় মহিতুল ইসলাম ও আবদুলকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং বাসায় আর কি ঘটেছিল তা জনাব ইসলাম জানতে পারেননি।

স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে যিনি বাংলার মানুষের কাছে এনে দিয়েছিলেন, তিনি ঘাতকদের হাতে বুলেটের গুলিতে নিহত হন। ঘাতকদের কারণে বাংলাদেশ হারালো তার জাতির পিতাকে আর বাঙালি হয়ে পড়লো অভিভাবকহীন। শোকের মাস আগস্ট। আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র: মামুন, মুনতাসীর (২০১২), বঙ্গবন্ধু কোষ, ঢাকা: বাংলাদেশ শিশু একাডেমী।

লেখক: উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *