বছরে একদিন একুশ নয়, একুশ হোক প্রতিদিন

বছরে একদিন একুশ নয়, একুশ হোক প্রতিদিন

২১শে ফেব্রুয়ারি, বাঙ্গালিদের জন্য বিশেষ স্মরনীয় এবং গৌরবোজ্জ্বল দিন। এই বিশেষ দিনটির পিছনে রয়েছে আত্নত্যাগের ইতিহাস। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই তারা প্রথম আঘাত হানে ভাষার উপরই। যেহেতু ভাষাই হল সংস্কৃতির বাহক, তাই তারা জানত একটি জাতিকে ধংসের প্রথম ধাপই হল ভাষার বিনাশ।কিন্তু ভাষার মর্যাদা এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাজপথে নেমেছিল ছাত্ররা, তাদেরই রক্তে অর্জিত এই দিন।

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন বাংলার মাটিতে শক্তভিত্তি পায়। সাহসী বাঙালি আরও সাহসী হয়ে উঠে। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং জীবনাচরণে ভাষা আন্দোলনের ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের বিজয় বাঙালিকে আরও বেশি কিছু পাওয়ার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৬৯ এর গণ অঅভ্যুত্থান, ও ৭১ এর স্বাধীনতা।

আর এই স্মরনীয় এবং গৌরবোজ্জ্বল দিন অমর একুশে নিয়ে মনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের মনের কথা তুলে ধরেছেন সাগর দে।

স্মার্টনেসের নামে ভাষার বিকৃতি হয়ে উঠেছে অনবদ্য

প্রথমত একটা জাতি বা একটি জনপদ তৈরি হয় নির্দিষ্ট একটি ভাষার পরিচয়ে। পৃথিবীতে যখন স্টেট এর কোনো ধারণা ছিল না তখন মানুষ কথা বলতে জানতো না। বিভিন্ন ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতো। আস্তে আস্তে যখন মানুষ ভাষার উদ্ভব ঘটালো এবং তাদের যোগাযোগ আরো বিস্তার লাভ করল, ঠিক তখনই মানুষ একতাবদ্ধ হওয়া শুরু করলো।

যার ফলে গঠিত হলো ভাষা ভেদে আলাদা আলাদা কমিউনিটি। এরপরই উদ্ভব সিটি স্টেট, স্টেট এর। যদিও স্টেট গঠনের পিছনে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ভূমিকা রয়েছে তারপরেও ভাষার ভুমিকা অন্যতম।

এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। ১৯৭১ এর আগে দেশ দুটি একটি দেশ থাকলেও তাতে সবচেয়ে বড় ভিন্নতা ছিলো ভাষায়। যার ফলে বায়ান্নর রক্তঝরা ফেব্রুয়ারি। আর এই চেতনাকে ধারণ করেই ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির লড়াই। আর সে লড়াইয়ে বিজয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই আজো গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ভাষা আন্দোলনের সেই বীর সন্তানদের।

কিন্তু এত রক্তঝরা এই ভাষার আজ এ কি করুণ অবস্থা! স্মার্টনেসের নামে ভাষার বিকৃতি হয়ে উঠেছে অনবদ্য বিষয়। প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদেশী ভাষা-সংস্কৃতির চর্চা। প্রশাসনিক, শিক্ষাক্ষেত্র ও পেশাগত জীবনে বাংলা ভাষার ব্যবহারে রয়েছে ব্যাপক সংকীর্ণতা ও উদাসীনতা। এসব সংকীর্ণতা কাটিয়ে প্রিয় মাতৃভাষার যথাযথ মর্যাদা দিতে পারলে তবেই সার্থকতা পাবে সালাম-রফিক-জব্বার এর বায়ান্নর সেই ত্যাগ।

আব্দুল ওহাব
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
বশেমুরবিপ্রবি


বাকস্বাধীনতা আমাদের মৌলিক অধিকার

আমরা জন্মলগ্ন থেকেই বাংলা ভাষা টা আয়ত্ত্ব করে ফেলি। আর সূচনা ঘটে মায়ের থেকেই। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাকে মায়ের ভাষাও বলা চলে। সেই ভাষা যদি কেও কেড়ে নিতে চায় তাহলে কান্ডারি হয়ে দাড়াতেই হয়। বাকস্বাধীনতা হলো মৌলিক অধিকার। সেই অধিকার কেও ক্ষুন্ন করবে এমন হতে দেওয়া যায় না।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল এই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার অকাতরে প্রাণ দিয়েছে এমন উদাহরন বাংলার ইতিহাস ব্যতীত বিরল। আমাদের আরো একটি বড় পাওনা হলো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত প্রদান।

কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার অপব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজী ভাষার প্রাধান্য বাড়িয়ে দেওয়ায় বিভিন্ন অফিশিয়াল কাজে বাংলা ভাষাকে গন্য করা হয় না। এক ধরনের ভাষার বিকৃত হচ্ছে বলেই মনে করি আমি। আত্নত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই ভাষা, অর্জন পর্যন্ত থেমে গেলেই চলবে না, এই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করাও উচিত। অর্জনের থেকে মর্যাদা রক্ষাই কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি করে ভাষা বিকৃতিকরন এবং অপব্যবহার কমিয়ে আনা হোক এইটাই আমাদের সকলের কাম্য।

নুসরাত জাহান
ইতিহাস বিভাগ
বশেমুরবিপ্রবি


আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে আমরা হাসাহাসি না করি

“ফাল্গুণ মানে বর্ণ মালার খেলা
ফাল্গুণ মানে হাজার ফুলের মেলা”

কি মধুর এই সুর-বানী। কি হতো- যদি এই ভাষাটা না থাকত?এত কাব্য এত কবিতা কে লিখতো? ভালোবাসি এই মিষ্টি কথাটা কে বলত? মাকে এত মধুর সুরে কে ডাকত? হা এই বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য যারা ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি ভাষার মাসে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

এই ভাষার প্রতি আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন। তবে বর্তমানে দেখা যায় আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে আমরা হাসাহাসি করি কিন্তু এটা আমাদের মোটেই কাম্য নয়। আমাদের প্রত্যকের উচিত প্রত্যকের ভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা । কারণ জন্মের পরই আমরা সবাই মায়ের মুখের ভাষা থেকেই মূলত কথা বলা শিখি।

শুধু যে কথাবার্তার চর্চায় এই আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হয় বিষয়টা তেমন নয়।অনেক সাহিত্য, কবিতা, গান ও নাটকে যুগ যুগ ধরে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার হয়ে আসছে।সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমানের মতো বোদ্ধারাও আঞ্চলিক ভাষায় অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন।

আরমান সাগর
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ
বশেমুরবিপ্রবি


আমাদের উচিত বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করা

বাঙালির জীবনের একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হল একুশে ফেব্রুয়ারি । এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত। বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এটি গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। এই মহান শহীদদের রক্তের বিনিময়েই বাংলা ভাষা তখন রাষ্ট্রভাষার সম্মান পেয়েছিল।

প্রতি বছর সম্মানের সহিত এই দিনটি উদযাপনের সাথে সাথে আমাদের উচিত বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও সুনাম বৃদ্ধি করার জন্য সর্বোচ্চ সচেস্ট থাকা ।

অলোক মল্লিক
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
বশেমুরবিপ্রবি


একুশ অসাম্প্রদায়িক

২১শে ফেব্রুয়ারি!আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।আসলে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি।” সৌভাগ্যের বিষয় দিবসটি আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রে মাতৃভাষায় কথা বলার স্বীকৃতি প্রদান করেছে। তবে আজকের দিনে বেশকিছু বিরূপ ভাবনা আমাদের মনের কোনে উঁকি দেয়। কেননা যেভাবে আমরা সবাই ইংরেজি ভাষা গ্রহন করতে ইচ্ছুক,তাতে সত্যিকার অর্থেই বাংলা ভাষা আজ অনেকখানি বিপন্ন।একুশের ইতিহাস বাঙ্গালির চেতনায়,মেধা ও মননে তথা বাঙ্গালিকে কতটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছে,সেটা সন্দিহান!

আজকের এই সংকটময় মুহূর্তে একুশ স্মরণের তাৎপর্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিমুখে ঠেলে দিতে একুশে স্মরণ খুব প্রয়োজন।আমরা মাতৃভাষার অধিকার পেয়েছি রক্তের অক্ষরে।আর এই মাতৃভাষা চর্চার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রাণ ভোমরা।তাই এই একুশের ঐতিহ্য বহন করে ব্যক্তি জীবনের সাথে সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক চর্চাকে আরো নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে পারি,সেটাই হোক আমাদের প্রতয়,আমাদের স্বপ্ন।

কাজের ভাষা হিসেবে বাংলা গুরুত্ব হারালেও সৃজনশীল সাহিত্যপাঠের অনুরাগী মন কিন্তু কমবে না।জীবনধারার সাথে সম্পর্ক রেখে ইতিমধ্যে অনুগল্প জনপ্রিয় হয়েছে। সময় কোথাও থমকে দাঁড়ায় না।মৈথিলী ভাষার বুক থেকে বাংলা বেরিয়ে এসেছে, কোনো এক সন্ধিক্ষণে বাংলার বুক থেকে আরও এক নতুন ভাষা বেরিয়ে আসবে সময়ের দাবি মেনে।

পরিশেষে বলব,একুশের জায়গাটা হচ্ছে উত্তরনের পথ।একুশ অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ।বছরে একদিন একুশ নয়,একুশ হোক প্রতিদিন।

নূপুর গোলদার
বাংলা বিভাগ
বশেমুরবিপ্রবি ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *