বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর জুড়ে যা ছিলো আলোচনা-সমালোচনায়

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর জুড়ে যা ছিলো আলোচনা-সমালোচনায়

মাসুম মাহমুদ, ববি প্রতিনিধিঃ বছরের শেষ সূর্যাস্ত মনে করিয়ে দেয় অনেক কিছু। হিসেবের খেরো খাতা ঘেঁটে যোগ বিয়োগের ফলাফল মেলাতে হয়। পাওয়া না পাওয়ার সমীকরণ তো আছেই।

নতুন বছরে নতুন করে হালখাতা খোলার সময় স্মৃতিপটে নাড়া দিয়ে ওঠে পুরনো ক্ষত। সেই সাথে ভুলগুলো মেরামত করে সামনের দিকে এগুনোর এক মসৃণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়।

পড়াশোনা, আন্দোলন-সংগ্রাম, সভা-সমাবেশ, আড্ডা, সংস্কৃতি, আলোচনা-সমালোচনা,গবেষণা, ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। করোনা মহামারী পরিস্থিতিসহ কেমন কাটলো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সাল? কি কি ছিলো আলোচিত ঘটনা হিসেবে সমালোচনার বিষয়গুলোই কেমন ছিলো? নতুন স্বপ্ন নিয়ে বছরখানা শুরু করে কি পেল দক্ষিণের বাতিঘরের শিক্ষার্থীরা?

বছরের শুরু..

দীর্ঘ ছয় মাস ভিসি বিহীন থাকার পর নভেম্বরের শুরুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড.সাদেকুল আরেফিন দায়িত্ব গ্রহণ করায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়টি। আটকে থাকা ভর্তি পরীক্ষা ও একাডেমিক সেমিষ্টার ফাইনালসহ বিভিন্ন কার্যক্রম তরান্বিত হতে লাগলো, সেশনজট নামক আর্তনাদী শব্দের বিতাড়নের এক নব আশ্বাসে একরাশ আশা নিয়ে কীর্তনখোলার পারে যেন খোলা নিঃশ্বাস নিতে চাচ্ছিল সবাই।

সমালোচনার মাস ফেব্রুয়ারী

বছরের শুরুর মাসটা মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটে পার হলেও ফেব্রুয়ারী শুরু হতেই নানামুখী বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পত্র-পত্রিকার শিরোনামে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। কখনো মাঠ পরিষ্কারের নামে শিক্ষার্থীদের লাগানো অর্ধশতাধিক গাছে আগুন দেওয়া, কখনো খেলার মাঠে জয়ের পর ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষ। কখনো কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলার আসামী বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্যু ক্লার্ক এবং জেলা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বনি আমিনকে অবাঞ্ছিত ঘোষনা করে উত্তাল ববিপারা।

লিপ-ইয়ারের এই মাস শেষ হওয়ার প্রাক্কালেই ঘটতে চলেছিল আবরার হত্যার পুনরাবৃত্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই বাংলা হলের ৪০১৬ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র মো. শাহজালালকে তার কক্ষ থেকে ডেকে ১০০১ নম্বর কক্ষে নেয়া হয়। সেখানে হাত-পা ও মুখ বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ ও তদন্ত শেষে দু’জনের বহিষ্কার, একই দিন শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দু’গ্রুপের সংঘর্ষে চারজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। পৃথক ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাস চত্ত্বর।

এতশত সমালোচনার মধ্যেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় এসেছিল মজার একটি সংবাদ ‘ প্রেমের দায়ে বহিষ্কার হলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঙ্গেল কমিটির সহ-সভাপতি ‘

মার্চ- আরেক সমালোচনাময় অধ্যায়

মার্চের শুরুতে করোনা নিয়ে অত বিস্তর আলাপ না হলেও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমালোচিত ঘটনা বন্ধ থাকে নি। শুরুতেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রজমোহন কলেজের(বিএম কলেজ) শিক্ষার্থীদের এক গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি প্রতিষ্ঠানেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজমান ছিলো, সমালোচনায় ছিলো ববি প্রশাসনের পদক্ষেপ নিয়েও। এর মধ্যেই গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাথে বায়োকেমিস্ট্রি এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের মারমুখী আচরণও ছিলো আলোচনায়। ববি শিক্ষার্থী উর্মি’র উপর ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলা , স্বয়ং শিক্ষক জড়িত থাকার অভিযোগ ও ছাত্রলীগের গুজব বলে ঘোষণা দেওয়া ইত্যাদি চলমান-চিত্রে পরিনত হয়েছিল।

বছরের শুরুটা অপয়া ভাবে হলেও নতুন ভিসির আগমনে হাজারো আলোচনা-সমালোচনার মাঝেও শিক্ষা কার্যক্রমে কিছুটা গতি সবে আসতে চলেছিল। ভাগ্যবিধাতার মনঃক্ষুণ্নতায় করোনা ভাইরাসের প্রকোপে হঠাৎ থমকে গেল সব।

মাহামারিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

এরপরের হিসেব টা একেবারেই ভিন্নতর, প্রথমত লকডাউনে বন্দি দশায় ঘরে বসে থাকা,শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ জায়গা থেকে ত্রান বিতরণ কর্মসূচি, দু-একটি বিভাগের উদ্যেগে নিজ শিক্ষার্থীদের অর্থ সহায়তা ইত্যাদি। শিক্ষা কার্যক্রম সহ সবকিছুই যখন ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে ঘরে বসেই চলতে শুরু হলো। তখন অনলাইন ক্লাস বিড়ম্বনা, মেসে ভাড়া কমানোর জন্য প্রশাসনের সাহায্যের দাবীতে অনলাইন প্রতিবাদ কর্মসূচি ইত্যাদি। এরইমধ্যে ‘মাথা ন্যাড়ার হিড়িকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা’ এমন রসালো ঘটনা দিয়েও সংবাদ শিরোনামে ছিলো ববিয়ানরা।

প্রেমবিয়োগে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা, বঙ্গবন্ধু ও ধর্ম অবমাননা

পারিবারিক সমস্যার জেরে প্রেমিকের আত্মহত্যার দেড় মাসের মাথায় ববি ছাত্রীর আত্মহত্যা। গনিত বিভাগের এই মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন বিয়োগে শোকাহত ছিলো সম্পূর্ণ ববি পরিবার। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যে ক্ষত হয়েছে তার প্রকাশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফুটে ওঠে। এর-ই মধ্যে ইসলামি বিধি-বিধান নিয়ে কটুক্তি করায় সমালোচনার তিব্র স্রোত বয়ে চলে কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থীর ওপর। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে শোকজ করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সবশেষে বঙ্গবন্ধু পরিবার নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় লোকপ্রশাসন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থীকে।

এছাড়াও বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত, প্রথমবারের মতো গ্রামীন ফোনের সাথে চুক্তি, বিনামূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা, এক অধ্যাপক নিয়েই দশ বছরে পদার্পন, প্রাতিষ্ঠানিক মেইল প্রদান, প্রথমবারের মতো ফিল্ম আর্কাইভে গবেষণা ফেলোতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সবিশেষ, স্বাস্থ বিধি মেনে স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া ইত্যাদি।

এমন সব আলোচনা ও সমালোচনায় শেষ হলো দক্ষিণ বঙ্গের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপিঠের মহামারীময় বৎসর৷ এখন ভুল গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং ভালো কাজ গুলো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সামনে কতটুকু এগিয়ে যেতে পারবে তারা এটাই দেখার বিষয়। নতুন এক ভোরের প্রত্যাশায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *