বাংলাদেশ-নেপাল বাণিজ্য: অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দুয়ার

বাংলাদেশ-নেপাল বাণিজ্য: অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দুয়ার

আশরাফুল আলম


হিমালয়ের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা দেশ নেপাল। ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এটি যেন এক খণ্ড স্বর্গীয় রূপ। মূলত, পর্যটন খাতকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে নেপালের অর্থনীতির বড় একটি অংশ।

প্রায় বাংলাদেশের আয়তনের সমান ভূমিবেষ্টিত দেশটির সাথে আমাদের সম্পর্কের নতুন মোড় নিয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশটি নিরপেক্ষ আচরণ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে দেশটি আমাদের স্বীকৃতি দেয়। যার ফলস্বরূপ সেইসময় দেশটি পাকিস্তানের রোষানলে পড়ে বরং পাকিস্তান তাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে। যদিও পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক রূপ লাভ করে।

৭৫ পূর্ববর্তী সময়ে দেশ দুইটি তাদের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো নিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে এবং এখন তা নতুন মাইলফলকে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ থাকাকালীন সময়েই চারদিকে স্থলভুমিবেষ্টিত নেপাল বাংলাদেশের মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তাদের সে চেষ্টা আরও সহজলভ্য হয়ে গিয়েছিল।

বর্তমানে নেপাল মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। ফলে একদিকে তারা যেমন সহজে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে অপরদিকে আমরা অর্জন করবো বিশাল রাজস্ব যা দেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধশালী করবে।

বর্তমান আঞ্চলিক কূটনীতি বেশ জটিল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সৃষ্টির সূচনালগ্ন(১৯৪৭) থেকেই ভারত-নেপাল সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। আর থাকবেই না কেন বলুন, দুই দেশের ধর্মীয়, সংষ্কৃতিক মেলবন্ধন যেত একই সুতায় বাঁধা। ভারতের কাছে নেপালের ভূমি ছিল তীর্থস্থান কারণ স্বয়ং ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান বলে কথা। তাই তো ভারত নেপালের জনগণকে বেশ অগ্রাধিকার দিত। এমনকি দেশটির নাগরিকদের ভারত তার নিজ দেশের সরকারি চাকুরীতেও নিয়োগ দিত।

দুই দেশের জনগণ অবাধে দুই দেশে বিচরণ করতে পারতো এবং এখনও করে। বাণিজ্য নীতিতেও তারা একজোট বলতে গেলে। তাই ভারত কখনই নেপালের রাজনৈতিক ব্যাপারে নাক গলায়নি।নেপাল-চীন সম্পর্কের উন্নতি হয় তারও অনেক পড়ে। বলতে গেলে ১৯৬১ সালের দিকে। তখন দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

২০১৫ সাথে নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্প দেশটির অর্থনৈতিকে থামিয়ে দেয়। পর্যটন খাতে ধস নামে। ভারত,বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশ নেপালকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তবে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে একই বছর ভারত নেপালের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে দেশটির অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়।

নেপাল ধীরে ধীরে ভারত নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং বাংলাদেশ,চীন সহ বিভিন্ন দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। চীন আসলে সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় এবং নেপালকে বড় বড় বিনিয়োগে আকৃষ্ট করে। আমি দিক থেকে ধরতে গেলে আমি বলল এটা ভারতেই কূটনৈতিক ব্যর্থতাই বটে।

বর্তমানে নেপাল বিভিন্ন দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে ব্যস্ত। এই সুযোগটি আমাদেরকেও লুফে নিতে হবে। বাংলাদেশ ও নেপালের স্থল-সীমান্ত দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার যাকে শিলিগুড়ি করিডোর(ভারতের অংশ) হিসাবে ধরা হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে ফুলবাড়ি সীমান্তে (ভারতের ভিতর দিয়ে) নেপালের সাথে পণ্য পরিবহন করে থাকে। আমরা যদি চুক্তি অনুযায়ী আরও পাঁচটি সীমান্ত ব্যবহার করতে পারি তবে দেশের রাজস্ব যায় বেড়ে যাবে। সেই পরিকল্পনা নিয়েই সামনে এগোতে হবে আমাদের রাষ্ট্রকে।

নেপাল বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর রহনপুর রেললাইন দিয়ে ট্রেন ট্রানজিট চায়। তারা মংলা বন্দর থেকে পণ্য ট্রেনে করে রহনপুর হয়ে ভারতের ভিতর দিয়ে তাদের দেশে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক। এ নিয়ে তিন দেশ অবশ্য একমত সেটা আমরা আশা করতেই পারি। এতে যেমন পণ্য আমদানিতে তাদের ব্যয় করবে, অপরদিকে ভারত ও বাংলাদেশ লাভবান হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ তাদের দেশের কার্নালই নদীর উপর ৯০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী। এবং যুক্তি অনুসারে আমরা ৫০০ মেগাওয়াট দেশেই নিয়ে আসবো। ফলে এটাও বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক বলেই মনে করি।

স্থল ও সমুদ্র পথের পাশাপাশি নেপাল আমাদের আকাশ সীমা ব্যবহারেও আগ্রহী। সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহার করার জন্য নেপাল আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি তাদের এ সুবিধা দিলে একদিকে যেমন রাজস্বের ব্যাপার থাকবে অন্যদিকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নতি করা সহজতর হবে। ফলস্বরূপ রংপুর অন্ঞলে শিল্পকারখানা তৈরিতে বিনিয়োগ বেয়ে যাবে তথা দেশের অর্থনীতিকে আরও একধাপ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

মূলত বাংলাদেশ, নেপাল হতে চাল,ডাল, গম ইত্যাদি আমদানি করে থাকে। পক্ষান্তরে নেপাল, বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস, ঔষধ, হস্তশিল্প আমদানি করে থাকে। তবে আমদানি-রপ্তানি এ হিসাব টাকার অংকে মাত্র ৩০০কোটিরও কম। ফলে বাণিজ্যে অগ্রগতি আনতে হলে ট্রানজিট রুট বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি। তবে নেপাল-বাংলাদেশে যাই করুক না কেন তা অবশ্যই ভারতের মাটি ব্যবহার করেই করতে হবে। তাই আমাদের উচিত সীমান্ত উত্তেজনাকে কুটনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে বাণিজ্যনীতিকে এগিয়ে নেয়া।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধির দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এখন প্রথম স্থানে। তাই অর্থনীতির এ ধারাকে সচল রাখতে হলে বহির্বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *