বাবাদের ত্যাগময় জীবন

বাবাদের ত্যাগময় জীবন

আলমগীর হোসেন


একটি বিমান আকাশে মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিমানটি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলল। সকল যাত্রী ভয়ে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু সে সময় একটি ছোটো মেয়ে তার খেলনা দিয়ে খেলছিল। তার মধ্যে কোন ভীতি কাজ করছিল না!

এক ঘণ্টা পর বিমানটি এয়ারপোর্টে নিরাপদে অবতরণ করল। একটা লোক, ছোটো মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল- “তুমি খেলছিলে কিভাবে? যখন আমরা সবাই ভয়ে অস্থির ছিলাম?

ছোটো মেয়েটি হাসল আর বলল- “আমার বাবা এই বিমানের পাইলট ছিলেন।

আমি জানতাম তিনি আমাকে নিরাপদে মাটিতে নামাবেন। কারণ বাবা আমাকে বলেছেন, আমি সাথে থাকলে তোমার কোন ভয় নেই।”

বাবাকে নিয়ে সন্তানের অনুভূতিগুলো সবসময়ই মনের গহীনে চাপা পড়ে থাকে। বাবার ত্যাগ, তিতিক্ষা, স্নেহ, রাগ, ভালোবাসা সন্তান আগলে বুকের এক কোণে। কখনো মুখ ফুটে বলা হয়ে উঠে না, বাবা ভালোবাসি।
শৈশব, কৈশোর আর যৌবন। যেন চোখের সামনে পার হয়ে গেল সব।

বয়সের হিসেবে যৌবনের দুরন্ত সময় এখন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বর্ডার এলাকায় এক অখ্যাত পাড়াগাঁয়ে বাড়ি আমাদের। কৃষক বাবার একান্নবর্তী পরিবারে এক ভাই আর এক বোনের সংসারে আমি ছোট। সংসারের সম্পদ বলতে আছে অল্প কিছু জমি। তাতেই চাষাবাদ। সাথে বর্গা নেওয়া আরো কিছু জমি। তাতেও যখন হয় না, তখন অন্যের জমিতে চলে বাবার কামলাগিরি।

হেমন্তের শেষ দিকে গ্রাম জুড়ে চলতো নবান্ন উৎসব। খাইরুল চাচা, শাহিন খালু বা বুলবুল ভাইদের জমিতে তখন ধান কাটার ধুম। যেন পুরো এক উৎসব। খুব সকালে জমিতে কাস্তের ‘খ্যাস খ্যাস’ শব্দে চলত ধান কাটার হিড়িক। কে কত দ্রুত কাটতে পারে ধান, তা নিয়ে হত অলিখিত এক প্রতিযোগিতা। বেলা বাড়ার সাথে খালেক চাচার মহিষের গাড়িতে করে তা বাড়িতে আনা। ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র আসেনি তখনো। উঠোনে মহিষ বা গরু ঘুরিয়ে চলত ধান আলাদা করার কাজ।
আমাদের আর কতটুকুই বা জমি।

ওজন মাপার স্কেলে তা অল্প কয়েক মণে ঠেকে। তাই প্রায়ই দেখতাম বাবাকে অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতে। চার সদস্যের পরিবারে সব সময়ই কেউ না কেউ অতিথি হয়ে থাকত, মায়ের কূলের নয়তো বাবার কুলের। সাথে দুই ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ। সবকিছু সামলে নেওয়া বাবার পক্ষে সহজ ছিল না মোটেও।

স্কুলের পাঠে কেবল টু-থ্রি ক্লাসে পড়ি তখন। শিক্ষা উপকরণ ছিল রংহীন স্লেট, সাথে চক পেন্সিল আর মহানগরের মোটা খাতা। সব মিলিয়ে ১৫-২০ টাকা লেগে যেত তাতে। সপ্তাহে হাট বসতো দুদিন- সোমবার আর বৃহস্পতিবার। আমার জন্য তা খুশির দিন। বাবার সাথে বাজারে গেলে গুড়ের মোয়া আর ‘দাঁতভাঙা’ নামের খাবার পাওয়া যেত। সাথে সুযোগ মতো আমার খাতা-কলম। তাই হাটবার এলেই তাই বাবার পিছনে পিছনে ঘুরতাম। কিন্তু হাটের দিন বাবার মুখটা মলিন থাকত প্রায়ই। মোটা চাল, তরিতরকারি, আর কখনো পাঙাশ বা সিলভার কার্প মাছ। বেশিরভাগ হাটের দিনে আমার খাতা-কলমের স্বপ্ন পূরণ হত না। বাবা বলতেন, সামনের বার ঠিকই কিনে দেব।

কচি হৃদয়ে মন খারাপের ছায়া। মুড়ি-মুড়কি খেতে খেতে বাজারের ব্যাগ কাঁধে বাড়ি ফিরতাম। প্রাইমারি, হাইস্কুল বা কলেজ, বেশিরভাগ সময়ই তো কাটল অপূর্ণ স্বপ্ন লালন করে। সেই বাবার সন্তান পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ভুলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে।

হাসিমুখে বাবার কত স্বপ্ন বিনির্মাণ, বড় হলে সব পাবি দেখিস। এত ভাল কিছু পাবি, তখন আর এসব মনেই থাকবে না। স্বল্প শিক্ষিত বাবার চোখে-মুখে দেখতাম আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নের ঝিলিক।

কত ঈদই তো আসে যায়। সেই সময়ের ঈদের কথা ভুলতে পারি না এখনো। এক মাস রোজা শেষে পশ্চিমাকাশে চাঁদ দেখা দিলে শুরু হত এলাকার ছেলে-মেয়েদের আতশবাজি ফোটানো, হই-হুল্লোড় আর ঈদ এলো ঈদ এলো রে গানের কোরাস। এখন মনে হয়, সে সময় কেবল নীরব আর নিস্তব্ধ ছিল আমাদের পরিবারেই। রাত পোহালেই ঈদ। নতুন জামা তো দূরের কথা, সামান্য সেমাই-চিনি কেনার জন্য দরকারি একশ টাকাও কেন জানি জোগাড় হচ্ছিল না।

ল্যাম্পের কালি ওঠা আলোয় আমি পড়ার টেবিলে চুপচাপ, যেন স্থির। বাবা এসে পাশে বসলেন, ‘কি লাগবে তোর।’ বাবার মুখের দিকে তাকানোর সাহস ছিল না সে সময়। বললাম, কিচ্ছু লাগবে না বাবা। হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। বাবা আগলে ধরেন বুকের মাঝে। বলে উঠেন, পাগল ছেলে। তুই একদিন ব্যাগ ভর্তি করে সবার জন্য শপিং করবি, ভ্যান ভর্তি করে বাজার নিয়ে আসবি। আর কটা দিন, দেখতে দেখতে চলে আসবে দেখিস।

ঘুম থেকে উঠে সকালে ঠিকই আমাদের সবার নতুন জামা-কাপড় পেয়েছি। আর ঈদের প্রয়োজনীয় বাজারও এনেছিলেন বাবা। রাজ্যের দুঃখ নিয়ে ঘুমানো এই আমি সকালে প্রিয় জুতা পেয়ে এত খুশি হয়েছিলাম যে আর কখনো এত খুশি হয়েছিলাম কি না মনে পড়ছে না।

আমার বাবা, স্বপ্নচারী একজন ব্যক্তি। স্বপ্ন লালন করতেন আর আমাদের ভাই-বোনের মাঝে তা বিলিয়ে দিতেন। ছোটবেলায় বাবার চারপাশে ঘুরঘুর করতাম। বাবা গরুর লাঙল নিয়ে হই হই, ডানে ডানে, বামে বামে, থাম থাম করে উর্বর জমি চাষ করতেন। ঘামে নেয়ে পড়তো সারা শরীর। বাড়ি থেকে মাথায় করে বাবার জন্য ভাত আর পানি নিয়ে যেতাম। বিশ্রামের সময় বাবা খেতেন আর গল্প করতেন। খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতাম। ভাবতাম, বাবা এত জানেন কি করে?

বাবা সম্পর্কে কিছু না বললে নয়!
বাবা শুধু একজন মানুষ নন, স্রেফ একটি সম্পর্কের নাম নয়। বাবার মাঝে লুকিয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুত মায়াবী প্রকাশ। বাবা নামটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কোন বয়সী সন্তানের হৃদয়ে শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসার এক অনুভব জাগে মানুষটি কতভাবে অবদান রেখে যান তার সন্তানের জন্য, যার চুলচেরা হিসাব করেও কেউ বের করতে পারবেন না। বাবার কাঁধটা কি অন্য সবার চেয়ে বেশি চওড়া? তা না হলে কি করে সমাজ সংসারের এতো দায়ভার অবলীলায় বয়ে বেড়ান বাবা। বাবার পা কি অন্য সবার চেয়ে বেশি দ্রুত চলে? নয়লে এতটা পথ এতো অল্প সময়ে এতো শক্ত করে সব কিছু আগলে রাখেন বাবা।আর বাবার ছায়া..?

সেটাও শেষ বিকেলের বটগাছের ছায়ার চাইতেও বড়। বড় যদি না হবে তাহলে জীবনের এতো উত্তাপ থেকে কি করে সন্তান কে সামলে রাখেন!
পড়ালেখা শেষ করে একদিন হয়তো চাকরি করবো। সেদিন বাবার সব অপূর্ণতা গুলো এতই বেশি করে এক ঈদে সবার জন্য না পাওয়া জিনিস গুলো ব্যাগ ভর্তি করে বাসায় নিয়ে যাব। বাবার জন্য কয়েক প্রস্থ কাপড় কিনবো, একটা পছন্দ না হলে অন্যটা পড়বে। সেদিন চাইলেই কিনতে পারবো অনেক কিছু, ইচ্ছে হলেই শখ পূরণ করতে পারবো।

কিন্তু ছোটবেলায় ঈদের সকালে ঘুম থেকে জাগার পরে দেড়শ টাকার রঙিন জুতা পাওয়ার যে আনন্দ, সেই আনন্দের সিকিভাগও সেদিন আর পাবো না।

লেখক: শিক্ষার্থী, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *