বাস্তবতা

বাস্তবতা

তাসনিয়া আলী

প্রখর রোদে জর্জরিত শরীরে রাবেয়া টানা পায়ে হেঁটে চলছে। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া জ্বলন্ত চুল্লির ন্যায় আচরণ করছে। মালিবাগ থেকে একটি জবের ইন্টারভিউ শেষ করে, সরাসরি বাস ধরে নীলক্ষেত। সেখান থেকে হেঁটে আসছে।রোকেয়া হলের গেট ধরে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির মোড়ে এসে পৌঁছল।

চত্বরে একটি গাছের চারিপাশে ইট বালু সিমেন্টের তৈরি সাধারনের বসার জায়গাটিতে বসে পড়ল। এই মূহুর্তে রোদের তীব্র আস্তরণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে এই গাছের ছায়ার আস্রয়টা ব্র্যান্ডের এসির বাতাসের থেকে কম অনুভূত হচ্ছে না। এক শীতল অনুভূতি তার হৃদয় স্পর্শ করলো। সাথে এই ক্যাম্পাসের স্মৃতি বিজড়িত প্রতিটি স্থান যেন মুগ্ধ ছড়াচ্ছে। কত সোনালী দিন অতিবাহিত করেছে এই ক্যাম্পাসের বুকে। সেই শুরু থাকেই ক্যাম্পাসটাকে সে সব সময় মায়ের কোলের সাথে তুলনা করেছে। মায়ের কোলের ছায়ায় যেমন সন্তান নিজেকে নিরাপদ মনে করে, তেমনই এই ক্যাম্পাসের বুকে সে তৃপ্তি অনুভব করে। প্রাক্তন হলেও ক্যাম্পাসটা তাকে নিজ দায়িত্বে হাত বাড়িয়ে আগলে নেয়। এমনটা ভাবতে ভাবতে মোর্শেদের ফোন।

–হ্যালো? রাবেয়া। কোথায় আছো?
–এইতো মাত্রই ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম। তোমার কত দেরি হবে? দ্রুত আসো,আমাকে আবার ফিরতে হবে।

মোর্শেদ দ্রুত আসার আশ্বাস দিয়ে ফোন রেখে দিল। রাবেয়ার আজকে একটু বেশিই ক্ষুধা অনুভূত হচ্ছে। পেটের মধ্যে মনে হচ্ছে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। পাশেই দেখতে পেলো ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে চায়ের ফ্লাক্স এবং কিছু বিস্কুট আর কলা নিয়ে বসে আছে । রাবেয়া হাত বাড়িয়ে ইশারা করতেই বাচ্চাটা উচ্ছসিত ভঙ্গিতে দৌড়ে এগিয়ে এলো।

–কী লাগবো আফা? চা না বিস্কুট? কেকও আছে। দিমু?
–একটা কলা আর একটা কেক দে ।
–আচ্ছা আফা দাড়ান, দিতেছি।

রাবেয়া বাচ্চাটাকে দেখে ভাবছে । ছেলেটা কী নিজের কাছে থাকা একটা কলা কিংবা একটা কেক খেয়ে দেখেছে? কী নিষ্ঠুর বাস্তবতা! নিজেই বিক্রি করে কিন্তু মন চাইলেই এক টুকরো খেয়ে দেখতে পারেনা।

বাচ্চাটা তার পাওনা বুঝে নিয়ে আবার বললো , আফা? ঠান্ডা লাগবো? আইনা দেই? পাশেই আমার আব্বার টং এর দোকান।

–না। আর কিছু লাগবে না। তুই আমাকে পারলে একটা পানি এনে দে।

বলা মাত্রই ছুটে চলে গেলো সে। রাবেয়া লক্ষ্য করলো, আসে পাশে অনেকে জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়েরা বসে আছে। দেখে বুঝায় যাচ্ছে তারা প্রেমিক প্রেমিকা এবং দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে ফেলেছে কিন্তু তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে আরো হাজার বছর তারা এভাবেই বসে কাটিয়ে দিতে পারবে ।

৮ বছর আগে যখন সে এই ভার্সিটিতে পদার্পণ করেছিল, তার সময়টাও খুব চমৎকার ভাবেই কেটেছে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা, ঘুরতে যাওয়া, একসাথে গ্রুপ স্টাডি তার মাঝে মোর্শেদের মত ভালো একজন বন্ধু পাওয়া। যার সাথে সে হাজার হাজার ক্রোশ পথ পাড়ি জমাতেও দ্বিধা বোধ করেনি।

রাবেয়া ভাবতে থাকে যদি জীবনটা ওই সময়টাকেই থেমে থাকতে তাহলে কতোই না ভালো হলো । কেনো তারা এই বাস্তবতার জোয়ারে নিজেদের ভাসিয়ে দিলো ? যেখানে ঠাই পাওয়া খুব কঠিন , নিজের অস্তিত্বের বিলীন এক নিমেষেই শেষ হতেও দ্বিধা সংকোচ করে না। কিন্তু একজন উচ্চাকাঙ্খী মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বা মেয়ের পক্ষে নিজের জায়গা থেকে বাস্তবতার জগতকে পরিহার করার কোনো সুযোগই নেই। কারণ তাদের বড় হওয়ার এক মাত্র হাতিয়ার জীবন যুদ্ধে নেমে যাওয়া, নিজের পরিচয় তৈরি করার উদ্দেশে লক্ষ্ লক্ষ্ চাকুরী সন্ধানরত ব্যাক্তিকে পিছনে ফেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পথ চলা ।

একসাথে লাইব্রেরীতে কত পাল্লা পাল্লি করে পড়েছে তারা। অনেকে তাদের সপ্নের শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে আবার অনেকে পাহাড়ের অর্ধেক পথ থেকে ছিটকে পড়েছে ।

রাবেয়া সে যুদ্ধে মোটামুটি রকমের ছিটকে পরা একজন মানুষ। চাকরির বয়স প্রায় শেষ,সে এখন প্রাইভেট জবের জন্য চেষ্টা করছে। মোর্শেদের সার্টিফিকেটের বয়স কিছুটা কম থাকার কারণে সে আরো দুইটা বিসিএস দিতে পারবে। সেইটাই এখন তাদের একমাত্র অবলম্বন। এই জন্য মোর্শেদ প্রাণপণে চেষ্টা করছে টিকে যাওয়ার। সে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মরত ছিল কিন্তু প্রিলিমিনারী পাস করার পর সেইটাও ছেড়ে দিয়েছে। শুধু রাতদিন লাইব্রেরীতে পড়ার মাঝেই অনুগত আছে ।হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো,

–হ্যালো, আব্বা।
–হ্যাঁ মা। কি রে কেমন আছিস ?
–আলহামদুলিল্লাহ আব্বা। আপনি কেমন আছেন? বাসার সবাই কেমন আছে?
–ভালো আছে মা।একটা কথা বলতাম ।
–বলুন আব্বা ?
–রাবিতার একটা বিয়ের প্রস্তাব আসছে। তারা অনেক আগ্রহ প্রকাশ করছে। কিন্তু কী যে বলবো! বুঝতে পারছি না।
–কেনো? কি বলবেন?
–না মানে, তোর আগে ওরে বিয়ে দিবো। ব্যাপারটা একটু কেমন না। তোর তো বিয়েটা এখনো হলো না এমনকি আমার হাতের অবস্থা টাও ভালো কি। কি যে করবো,কিছুই ভালো লাগেনা ।
–আব্বা দিয়ে দেন । তেমন ভালো হলে। আমার আশায় বসে থেকে কোন উপকারটা আপনাদের হয়েছে একটু বলুন তো? এখন থেকে কেও আসলে আমার পরিচয় টাও আর দিয়েন না আব্বা ।
–এইসব কী বলিস মা? আমি শুধু শুনলাম তোর কাছে। দুপুরে খাইছিস?

বাবার মুখে এই কথাটা শুনে রাবেয়ার চোখ ভিজে আসলো। সে খাইছি বলে ফোনটা রেখে দিল। নিজেকে এখন এই সমাজের বোঝা মনে করে সে। এত বড় জায়গা থেকে পথ চলা শুরু করে বড় বড় সার্টিফিকেট অর্জন করে আজ সে বেকারত্বের জালে বাঁধা পরে ছিটকে পরছে প্রতিটা জায়গা থেকে। আজ কাল বাসার ফোনটাও ধরতে ইচ্ছা করেনা তার। নিজেকে খুব অসহায় মনে করে।

-কতক্ষন এসেছো ?
–৩০ মিনিটস।
–রেগে যেওনা প্লিজ। একটু দেরি হয়ে গেলো ।
–সমস্যা নেই বসো ।

রাবেয়ার পাশে বসতে বসতে মোর্শেদ বললো ,

–লাঞ্চ করছো তো? ইন্টারভিউ কেমন হলো ?
–জানিনা কেমন হয়েছে, আজকাল ভালো খারাপের ভিত্তিতে কিছুই বলা যায় না। এইসব জায়গায় ক্ষমতার ভিত্তিতে অভিযান চলে।
–এইসব কথা বাদ আগে চলো কিছু খাওয়া যাক।
–থাক লাগবে না । আমি মেসে গিয়ে খেয়ে নিব । আর পকেটে টাকা আছে তোমার? যে গার্লফ্রেন্ডকে খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার অধিকার দেখাচ্ছ? সেটেলমেন্ট এ যাও আজীবন খাওয়ানোর দায়িত্ব নিও। এইসব আজাইরা কেয়ারিংয়ের দিন এখন শেষ । আমার এইসব কিছুই ভালো লাগেনা ।

মোর্শেদ কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে বসে আছে। কারণ এ কথার পেক্ষীতে কথা বলার কোন লাইন তার জানা নেই। কিন্তু সে রাবেয়াকে বলতে পারলোনা, তার ছোটবোন আজ তাকে বিকাশে কিছু টাকা পাঠিয়েছে। আর বলেছে , ভাইয়া তোর মন মত কিছু কিনে খাবি। এত পড়ার চাপ, খাওয়া দাওয়া ঠিক ঠাক করবি । একদম অনিয়ম করবি না কিন্তু ।

–তুই টাকা কোথায় পেলি?

কথাটার উত্তরে সে হেসে বলেছিল, তোদের জামাই আমাকে হাত খরচের টাকা দেই সেইখান থেকে জমিয়ে রেখে তোকে দেই ভাইয়া ।

শুনে রাবেয়া বললো, “আর বসে না থেকে দ্রুত চলো। তোমাকে রিটেনের বই গুলো কিনে দিয়ে বাসায় যাবো। তারপর টিউশন যেতে হবে।”

মোর্শেদ তাকিয়ে রইলো রাবেয়ার কষ্ট চাপা বিকৃত মুখের দিকে। এ মুখে আছে হাজারো না বলা ভালোবাসার কথা কিন্তু বাস্তবতার কষাঘাতে চাপা পরে তা ফিকে হয়ে গেছে, মলিন আকার ধারণ করেছে ।

দুজন হেঁটে চলছে ক্যাম্পাসের পথ ধরে, একই পথ, একই দুজন মানুষ, শুধু উদ্দেশ্য ভিন্ন। বাস্তবতার জালে আটকে পড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন দুটি হৃদয়ের পথ চলা। এটাই যেন বাস্তবতা।

তাসনিয়া আলী ,শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, মাগুরা সরকারী কলেজ,মাগুরা।

ছবি: রোদসী

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *