বিচারহীনতার সংস্কৃতি: ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও আমরা

বিচারহীনতার সংস্কৃতি: ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও আমরা

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


বুধবার রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা সরকারি বাসভবনে ঢুকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম ও তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলীকে কুপিয়ে জখম করে।

কয়েক মাস আগেও গাজীপুরে একজন সৎ ইঞ্জিনিয়ারকে অফিসে ঢুকে জখম করেছে, তারও কিছুদিন আগে একজন কলেজের অধ্যক্ষকে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে আর ডাক্তারদের কথায় কথায় তাদের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে।

এ ধরনের খবরগুলো পড়া সাধারন মানুষ হিসেবে আমার জন্য কাঙ্খিত নয়। আজকে সকালে ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তাঁর বাবাকে কুপিয়ে জখম খবরটি পড়েও মনটি ভীষন খারাপ হয়ে গেল। আমার কয়েকটি বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারলাম কারনটি ইউএনও ওয়াহিদা খানম স্থানীয়ভাবে দুনীর্তির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন।

বিকালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক জাহেদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ইউএনওর মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। মাথার খুলির হাড় ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। এটি মস্তিষ্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে প্রচণ্ডভাবে। ভেতরে রক্ত রক্ষণ হয়েছে। তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল না।’

এই কথাগুলো শুনতে টিভিতে ভাল লাগছিল না। ভাবছিলাম আমরা কতটা অসভ্য হলে এই কাজটি করতে পারি।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাংলাদেশে একটি পরিচিত কথা ৷ বলা হয়ে থাকে, এই সংস্কৃতির কারণেই এখানে অপরাধীরা বেপরোয়া৷ তারা আইনকে গুরুত্ব দেয় না, অপরাধ করতে ভয় পায় না৷ তারা মনে করে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়৷ এমন প্রত্যেকটি ঘটনার বিচার করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এতদূর নিয়ে এসেছে। এসব দুর্বৃত্তদের লাগাম টেনে ধরতে হবে, না হয় আমরা কেউ শান্তিতে থাকতে পারবেন না।

দেশটা একটা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে নিরাপত্তাও পাওয়া যাবে না। বিচারও পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ প্রয়োজন।

আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাংস্কৃতিক যে পরিবর্তনের দরকার ছিল, তা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি সেটার পরিবর্তন আনতে হবে। নারীর প্রতি সম্মান ও মর্যাদার যে একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার আছে, মননের ব্যাপার আছে—সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার, পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের যে সমীকরণ আছে সেটা বদলাতে হবে—এই বিষয়গুলোকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে ।

এ ধরনের ঘটনার সুরাহা হতে পারে যখন যারা ওই ঘটনার সুরাহা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক থাকে। আমরা কেবল সরব হতে পারি এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদে বা প্রতিরোধে। আমরা সরব হতে পারলেও আমাদের এখতিয়ার তো সীমাবদ্ধ।

আমরা তো অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারি না, এ ধরনের ঘটনায় অপরাধীদের বিচারের যে বাস্তব প্রক্রিয়া তার মধ্যে যেতে পারি না। সেগুলো যারা করবে, আমরা যাদের কাছে বিচার চাইলাম তারা বিচার করল না; আমরা তখন কী করতে পারি! তাই এগুলো যাদের দায়িত্ব তাদেরই আন্তরিকভাবে এ ধরনের অপরাধের বিচার করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এ ধরনের হত্যা কান্ডের বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা কতখানি! হয় তাদের সক্ষমতা নেই, না হয় তারা আন্তরিক নয়। দুটিই আমাদের জন্য বিপজ্জনক।

এসব ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তারা যাতে আন্তরিক হয় সেই চেষ্টাও আমাদের করতে হবে। এর জন্য আমাদের বারবারই কথা বলতে হবে। গণমাধ্যমও সেখানে ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের তো একটা দায়দায়িত্ব আছেই। আমাদের জায়গা থেকে আমাদের সেটা করতে হবে। তবে রাষ্ট্র কেবলমাত্র নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।

আশা করি, সরকার একজন সৎ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবি হিসেবে শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে কর্মরত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক, ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ও গবেষণায় প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশীপ প্রাপ্ত।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *