বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স ও শিক্ষার্থীদের ভাবনা

বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স ও শিক্ষার্থীদের ভাবনা

‘সান্ধ্যকোর্স মুক্ত ক্যম্পাস’ শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সান্ধ্যকোর্সের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সেই দাবি মেনে নেয়নি। সান্ধ্যকোর্স একটি বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া ও এটি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যাহত করছে বলে দাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

এদিকে সান্ধ্যকোর্স নিয়ে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এ্যাড. মো. আবদুল হামিদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর সান্ধ্যকোর্স বন্ধের নির্দেশনা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসির এই নির্দেশনার পর সান্ধ্যকোর্স বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জগন্নাথ ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবার বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নেবার পালা। এদিকে এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে শুরু হয়েছে সমালোচনা।বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স থাকা কতটুকু যৌক্তিক এবিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য ক্যাম্পাস টুডের রাবি প্রতিনিধি ওয়াসিফ রিয়াদ



বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদানে সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করতে হবে
শেখ শোভন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সান্ধ্যকালীন কোর্স মূলত সার্বজনিন শিক্ষার যে ধারণা এবং শিক্ষার অধিকার আমাদের সংবিধানে দেওয়া হয়েছে তার বিরোধী। টাকার বিনিময়ে কিছু মানুষ নামেমাত্র ক্লাশ-পরীক্ষা দিয়ে একটা সার্টিফিকেট পাবে তা একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের সাথে বেমানান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং একমাত্র কাজ হচ্ছে জ্ঞানের সাধন এবং নতুন জ্ঞান তৈরি। আমরা দেখেছি বর্তমানে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালুর মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু জ্ঞানের সাধনার অপ্রতুলতার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংক ক্রমাগত নিচে নামছে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জনগনের অর্থে পরিচালিত হয়।

এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছু শিক্ষক অর্থ উপার্জনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বানানোই এই সান্ধ্যকালীন কোর্সের লক্ষ্য। আর এর প্রভাবে আমরা যারা নিয়মিত শিক্ষার্থী তারা প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছি। বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদান করতে হলে সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করতে হবে।

সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় কে তার অতীত ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতে অনতিবিলম্বে এই বাণিজ্যিক কোর্সগুলকে বন্ধ করে নিয়মিত ছাত্রদের গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।



শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করতে হবে
ইমরান ফারুক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


দেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, মেধাবী ও দক্ষ মানব সম্পদ গড়ার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ লক্ষ ভর্তিচ্ছুদের মধ্যে অল্প কিছু সংখ্যক ভর্তিচ্ছু কঠিন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়।

তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত কষ্ট করে পড়াশোনা করার একটাই উদ্দেশ্য উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালিন কোর্সে সঠিকভাবে যাচাই বাছাই পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে উচ্চতর ডিগ্রী পাইয়ে দেওয়ার নাম করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয়। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকরা বিশ্ববদ্যালয়ের পড়–য়া নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস পরিক্ষা গবেষনা কাজ বাদ দিয়ে অধিক টাকা আয়ের লক্ষ্যে সান্ধ্যকালিন কোর্সে সময় দিয়ে থাকেন।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যহত হচ্ছে। এমনিভাবে চলতে থাকলে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীরা উচ্চ শিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষিার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে বানিজ্যিক সান্ধ্যকালিন কোর্স বন্ধ করা এখন সময়ে দাবি।



সান্ধ্যকোর্সের নামে চলে রমরমা ব্যবসা
তাসবিয়া ইসলাম তুলি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সান্ধ্যকোর্স একটা বাণিজ্য ছাড়া কিছুই না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মুক্ত চর্চা হবে, পড়াশোনা হবে গবেষণা নির্ভর। সেখানে তা না হয়ে শুরু হয়েছে রমরমা সান্ধ্যকোর্সের ব্যবসা। এ ধরণের বাণিজ্যিক সনদপত্র বিক্রির পন্থাগুলো অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। এ ধরনের কোর্সের জন্য ভুরি ভুরি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোর্স কেন জারি থাকবে? বিশ্ববিদ্যালয় একটা উন্মুক্ত প্রতিষ্ঠান যেখানে শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের মেধার প্রমাণ দিয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। সেখানে টাকার বিনিময়ে কেউ একই সনদপত্র অর্জন করবে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

এই সান্ধ্যকোর্স বন্ধের দাবিতে পূর্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো। কিন্তু তাদের দাবি মানা হয়নি উপরন্তু শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে চরম বাঁধার সম্মুখীন হয়। তবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সুদৃষ্টির ফলে আমরা আশাবাদী এ ধরণের সমস্যা অতি শীঘ্রই সমাধান হবে। যা পূর্বের এবং বর্তমান সকল শিক্ষার্থীর কাম্য।



শিক্ষা বাণিজ্য এক সাথে চলে না
মেরিন রুম্পা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


‘দেশের ফকির ভিক্ষা পায় না, ভিন্নদেশী ফকির পায় দাওয়াত’! যখন দেশের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী সন্তানরা স্বপ্নমুখী হয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় ভর্তিযুদ্ধে সংগ্রাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তখনি দেখতে পায় শিক্ষা বাণিজ্য। শিক্ষকরা তাদের সৃজনশীল মেধা কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করলে হয়তো লাভবান হবেন কিন্তু তাদের ব্যবসার মূলধন শিক্ষাই কেন?

শিক্ষাকে পুজি করে ব্যবসায় ভালোই মুনাফা গুনে। কিন্তু শিক্ষা পুঁজিবাদের কষাঘাতে শোষন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা। যেখানে সন্ধাকালীন ব্যাচগুলোতে ক্লাস নেওয়ার পরেরদিন সকালে ঝিমাতে ঝিমাতে রাজকীয় কায়দায় ক্লাসে ঢুকে লেকচার রেডি না করে। এটেন্ডেন্সের জন্য একটা কগজ ছুড়ে দিয়ে রোল নম্বর নিয়ে আই ওয়াশ করে। আদৌও সেটার পারসেনন্টন্স হিসাব করে কিনা প্রশ্নবিদ্ধ। এতে কষ্ট করে দিনের পর দিন ক্লাস করা শিক্ষার্থীরা হতাশা ছাড়া কিছুই পায়না।

একজন শিক্ষক একজন মানুষ, সে সুপার ন্যাচারাল কিছু না যে, ডিপার্টমেন্ট, পরিবার,সমাজ, গবেষণা সব দায়িত্ব পালন করেও আবশিষ্ট সময় থাকবে সন্ধাকালিন ব্যাচ পড়ানোর। শিক্ষকরা যখন সান্ধকোর্সের দিকে ঝুকে পরে ঠিক তখনই বঞ্চিত হতে থাকে নিয়মিত র্শিক্ষার্থীরা।



সান্ধকোর্সের ফলে বঞ্চিত হচ্ছে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা
আরেফিন মেহেদী হাসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সান্ধ্যকোর্স পরিচালনা নিয়ে নানা বঞ্চনা ও অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন, ক্লাস না করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, দ্রুত সময়ে খাতা মূল্যায়ন করা, অথচ নিয়মিত শিক্ষার্থীদের খাতা যথাসময়ে মূল্যায়ন না করে ফলাফল প্রদানে বিলম্ব ফলশ্রুতিতে সেশন জটে পরতে হচ্ছে।

এক শ্রেণির শিক্ষক নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা ঠিকমতো নেন না। তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য ঢাকায় অবস্থান করেন। কিন্তু সান্ধ্যকোর্সে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঠিকই হাজির হন ক্যাম্পাসে। এ প্রক্রিয়ায় ‘বিকল্প পথে’ নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরির সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও।

ইভিনিং মাস্টার্স কোর্সের ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশই নিয়মিত কোর্সে ভর্তির জন্য আবেদনেরই যোগ্যতা রাখেন না। কিন্তু এক শ্রেণির শিক্ষকদের কারণে এ ধরনের ছাত্রছাত্রীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী বনে যাচ্ছেন। ওই শ্রেণির শিক্ষকরা নিয়মিত কোর্সের ব্যাপারে উদাসীন। কেউ কেউ ক্লাস ফাঁকি দেন। এমনও চিত্র লক্ষ্য করা যায় যে রুটিন অনুযায়ী শিক্ষকদের ক্লাস থকে সকালে কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে সেই ক্লাস বিকালে নেওয়ার আশ্বাস দেয়। অথচ বিকালেই একইভবে ক্লাসে বসিয়ে রাখে শিক্ষার্থীদের কিন্তু শিক্ষকের হদিস মিলে না।

অথচ রাতের সান্ধ্যকোর্সে এর বিপরীত চিত্র ভেসে উঠে। এসময় শিক্ষকেরা যথাসময়ে ক্লাস এ উপস্থিত থাকেন এবং অনেক আন্তরিকতার সাথে তাদেরকে সেবা দেন অপরপক্ষে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা এইসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় প্রতিনিয়ত। এমনটাও লক্ষ্য করা যায় যে ক্লাসে রেগুলার স্টুডেন্টদের কোনো প্রোগ্রাম এর অনুমতি না দেওয়া হলেও দিব্যি ইভিনিং কোর্স এর শিক্ষার্থীদেরকে সকল প্রোগ্রাম এর অনুমতি প্রদান করা হচ্ছে।

এতে শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে রিতীমতো। অথচ এমনটা কাম্য ছিলনা কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলার স্টুডেন্টদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত সর্বাঙ্গে কিন্তু সেটার বিপরীত কিছু অপ্রিয় সত্য ঘটনা ও চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। সুতরাং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিল করা উচিৎ।


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *