বিশ্ববিদ্যালয় কি সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠান?

বিশ্ববিদ্যালয় কি সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠান?

ওয়াহিদ তাওসিফ

বিশ্বব্যাপী সংকট কোভিড-১৯ এর থাবায় থমকে দাড়িয়েছে গোটা বিশ্ব৷ মানুষ ক্রমাগত অসহায় হয়ে পড়ছে উন্নত সব চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির কাছেও৷ শিক্ষা খাতেও পড়ছে এর বিরুপ প্রভাব৷ দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষক – শিক্ষার্থীদের মাঝে রয়েছে সংশয় ও অপেক্ষার ঝড়৷ সরকার পরিস্থিতির সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েও প্রকৃতির অমোঘ নীতির কাছে বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে, বৃদ্ধি করতে হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মাত্রাও৷

সম্প্রতি অনলাইন ক্লাসের উপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) হতে ক্লাস নেবার অনুমতি আসলেও পরিক্ষা গ্রহন ও সেমিস্টার ফাইনাল গ্রহনে রয়েছে কিছু বিশেষ বাধ্য বাধকতা৷ শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পৃক্ত থাকতেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নেবার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে৷ অবশ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ দৌড় প্রতিযোগিতায় অনেকটা এগিয়েই রয়েছে৷ অনলাইন ক্লাস, পরিক্ষা, প্রেজেন্টেশন এমনকি সেমিস্টারও পার হচ্ছে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ প্রযুক্তির কল্যান অস্বীকার না করা গেলেও তার যথার্থ ব্যবহার এবং গভীর বিশ্লেষণ নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা – সমালোচনার ঝড়৷

শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনির দেয়া তথ্য অনুযায়ী তার দাবী অনলাইন ক্লাসে সম্পৃক্ত রয়েছে প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী৷ কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা – ব্রাক ইন্সটিটিউট অব গভনের্ন্স এন্ড ডেভেলপমেন্টের (Brac Institute of Governance and Development) এক গবেষণায় উঠে এসেছে অনলাইন ক্লাস দেখছে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং মাত্র ১ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশগ্রহণ করছেন৷

অনলাইন নির্ভর এই শিক্ষা প্রক্রিয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক জরিপে উঠে এসেছে অবাক করা তথ্য- বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেরিফাইয়েড ফেসবুক পেজ থেকে চালানো অনলাইন নির্ভর এই জরিপে দেখা যায় শতকরা ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করতে ইচ্ছুক হলেও ৫৫ শতাংশই এর বিপরীতে মত দেন। জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ণরত ২৩০০ জনের অধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস না করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন৷

বিতর্কিত এই শিক্ষা প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া৷ বেশিরভাগ মেধাবী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এই প্রক্রিয়ায় তাদের মেধা যাচাই সম্ভব নয়৷ অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল ডিভাইস এর নীতিবিরুদ্ধ ব্যবহার এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা৷

আরও পড়ুনযদি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতাম

শিক্ষা নিয়ে গবেষণারত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও ভাবছেন গভীর ভাবে৷ তাদের মতে ইউটিউব দেখে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ হওয়া এবং অনলাইনে ক্লাস করে সেমিস্টার পার করার মাঝে বিশেষ কোন তফাৎ নেই৷ দুটোতেই রয়েছে প্রান নাশের ঝুঁকি৷ ভুল চিকিৎসায় অল্প সংখ্যক মানুষ মারা গেলেও ভুল এ শিক্ষা প্রক্রিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে গোটা জাতি৷

অনেকে মনে করতে পারেন তাহলে কি অনলাইন নির্ভর এগুলো কি কিছুই চলবে না? অথবা সেশনজট মেনে নিবে? বা বিকল্প পথই বা কি? তাদের উদ্দেশ্য বলতে চাই, সেশনজট নতুন কোন কনসেপ্ট নয়৷ সাধারণ সময় গুলো মতেও সেশন জটের চিত্র হারহামেশাই দেখা যায়৷ সেশনজটের দোহাই দিয়ে অনলাইন নির্ভর এক জাতিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো থাবার মুখে ঠেলে দেয়ার দায় কে নিবে?

কঠিন প্রতিযোগিতার এই চাকুরী বাজারে অনলাইন শিক্ষা বিশেষ কি ভূমিকা এ নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের৷ বিশ্ববিদ্যালয় মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য ভাবনার উপকরণের যোগান দেয়৷ আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা ইউনিভার্সিটি কোন সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠান নয়৷

অনলাইনে সেমিস্টার শেষ করা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক নাসির উদ্দিন জানান- “একটি জাতিকে বিকাশিত ভাবনার জগতের স্বাদ দিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য ৷ মহামারীর এই কঠিন সময়ে শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত রাখা গেলেও যথারীতি সেমিস্টার পার করা নিয়ে রয়েছে সংশয়৷ একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অতলে ডুবে যেতে পারে আমাদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ সন্তানরাও৷ ”

মহামারীর মাঝে বিকল্প হিসেবে অনলাইন ক্লাস চালানো গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও অনলাইন পরিক্ষা, প্রেজেন্টেশন, ভাইভা এবং অনলাইনেই সেমিস্টার শেষ করার বিপক্ষে মত দিচ্ছেন বেশিরভাগ শিক্ষাবিদ৷

অনলাইনে ক্লাস নিয়ে মেধা যাচাইয়ের যথার্থতা নিয়ে এক জরিপে উঠে এসেছে শ্রেনিকক্ষের প্রায় বেশিরভাগ মেধাবী শিক্ষার্থীরা দায়সারা ভাবেই অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষকরা কতটা গুরুত্ব দিয়ে তাদের পরিক্ষার নম্বর বন্টন করছেন তা নিয়েও রয়েছে নানা যোজন – বিয়োজন৷

শুধু অনলাইন এই শিক্ষা পদ্ধতির আওতায় এনে সেমিস্টার পার করার অসুস্থ মানসিকতার জন্য সমস্যার শিকার হচ্ছে খোদ সাধারণ শিক্ষার্থীরাও৷ তাদের অভিযোগ করোনার এই কঠিন সময়ে যেখানে মানুষ জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি দাড়িয়ে আছে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সেমিস্টার ফি চালানো আসলেই কঠিন হয়ে পড়েছে অনেকে কাছে৷

সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে মানুষের চিন্তা করার সামর্থ্য নেই৷ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অনেক বিরুদ্ধ পরিস্থিতি আমাদের সকলেরই মেনে নিতে হয়৷ যেখানে শিক্ষার নামে চলে অবাধে ব্যাবসা সেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সংশয়কেও উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়৷ বেঁচে থাকলেই আমরা শিক্ষার কথা চিন্তা করতে পারি,যেখানে মানুষের অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে হয় সেখানে এই লোক দেখানো উন্নয়ন দেশ ও জাতির কতটা উপকারে আসবে সে বিষয়টি ভাবার সময় এসেছে৷

প্রশ্ন আসতে পারে শিক্ষকদের দিকটাও বিবেচনায় রাখতে হবে৷ নিশ্চয়ই রাখতে হবে৷ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ অথবা সরকারি প্রনোদনা এখন সময়ের দাবী৷ একটা মানুষ যেখানে দুবেলা দু মুঠো খাবার নিয়ে ভাবে সেখানে সেমিস্টার ফাইনালের নাম করে অসুস্থ সব নিয়ম আর বিলাসিতা জাতির কাছে আজ অস্পষ্ট কিছু নয়৷

ডা. লুৎফর রহমান চমৎকার করে বলেছিলেন – কোন জাতিকে যদি বলা হয় তোমরা বড় হও, তোমরা জেগে ওঠো – তাতে ভালো কাজ হয় মনে হয়না৷ এক একটি মানুষ নিয়েই এক একটি জাতি৷ পল্লীর অজ্ঞাত – অবজ্ঞাত এক একটা মানুষের কথা ভাবতে হবে৷

পরিশেষে সমীকরন দাড়ায়, অনলাইনে ক্লাস চললেও পরীক্ষা নিয়ে সেমিস্টার পার করার যৌক্তিকতার বিচার এখন প্রশ্নবিদ্ধ৷ শিক্ষা মানুষের ভিতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তোলে৷ ভাসমান এবং অনিশ্চিত এই পদ্ধতিতে আগামীতেই তুমুল প্রতিদন্ধিতার চাকুরী বাজারে শিক্ষার্থীদের হতাশার কারণ হয়ে দাড়াবে না তো? প্রশ্ন সকলের৷

লেখক – ওয়াহিদ তাওসিফ (মুছা)
শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *