বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে জিপিএ অসমতায় হতাশ ভর্তিচ্ছুরা

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে জিপিএ অসমতায় হতাশ ভর্তিচ্ছুরা

মঞ্জুরুল ইসলাম আকন্দ

বশেফমুবিপ্রবি প্রতিনিধি


বাংলাদেশে ২০২০ সালের সর্বশেষ অধ্যাদেশ পাস হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি সহ ধরলে দেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০ টি।৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশে আর মাএ ৬ টি বিশ্ববিদ্যালয় হলেই প্রতি হাজার বর্গমাইলে গড়ে থাকবে ১ টি করে বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গড় ঘনত্বের জায়গা থেকে বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বে না হোক অন্তত এশিয়ায় জ্ঞানচর্চার একটি তীর্থভূমিতে পরিণত হবে এমনটাই প্রত্যাশা।

সমগ্র বিশ্বজুড়ে গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে যাকে ধরা হয় তা হলে বিশ্ববিদ্যালয়। আর এ বিশ্ববিদ্যালয় গুলো জাতিকে কি দিবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ভর্তি পরীক্ষা প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা উঠে আসছে কি না তার উপর।

বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় গুলো তাদের ভর্তি পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। ২০১৯-২০ সেশনের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা চালু আছে এমন ৩৯ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরিক্ষার সার্কুলারে দেখা গেছে ৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে জিপিএ র উপর নম্বর। যার ফলে দেখা যায় প্রকৃত মেধাবীরা তারা তাদের পছন্দের বিষয় বা পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২০০ নম্বর জিপিএতে । ভর্তি পদ্ধতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার জিপিএ তে সর্বোচ্চ ৬৭.৬৭ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ নম্বরের মধ্যে ৮০ নম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে বরাদ্দ।

২০১৯-২০ সেশনে সমন্বিত ৭টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গুলোতে দেখা যায় ২০০ নম্বরের পরীক্ষায় ১০০ নম্বর বোর্ড পরিক্ষার জিপিএ এর উপর।

বোর্ড পরিক্ষার ভিত্তিতে সবথেকে কম নম্বর বরাদ্দ রয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (১১.১১%), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৬.৬৭%) , এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৫%) ।

আরও পড়ুনবিদায় বেলায় ভালোবাসায় সিক্ত উপাচার্য, পুনঃনিয়োগের দাবি

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষায় নম্বর বিভাজনের এমন অসমতা ও অসংগতির কথা তুলে ধরে “দ্যা ক্যাম্পাস টুডে” কে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তারা তাদের মতামত ও অভিজ্ঞতা জানান।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী সুমাইয়া জাহান জ্যোতি ” দ্যা ক্যাম্পাস টুডে” কে বলেন “শিক্ষার নিম্নমানের জন্য ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএ-র ভ্যালু অনেকটা দায়ী। কারণ অসুস্থতা বা অন্য কারণবশত কোনো শিক্ষার্থী রেজাল্ট খারাপ করলে তার দায় ভার তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাতেও বহন করতেহয়৷ আর এর প্রেক্ষিতে অনেক শিক্ষার্থী সেকেন্ড টাইমারও হয়ে যায়। কারণ, যেখানে তারই সহপাঠী ১৪/১৫মার্কস এগিয়ে থাকছে তখন স্বভাবত সে মানসিকভাবে হতাশায় ভূগে। ভর্তি পরীক্ষায় সমান বা বেশি মার্কস পেয়েও ভর্তি হতে না পারার পেছনে এটাই দ্বায়ী। আর ভর্তি হওয়ার সুযোগ হলেও পছন্দের বিষয় পাওয়া ডুমুরের ফুলের মতোই দুষ্কর। অন্যদিকে যখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় চান্স পেলো তখন তার মনে হবে আমি হয়তো এটার যোগ্য নই কারণ, সবাই আমার থেকে মেধাবী।আবার তাকে নানা ধরনের উস্কানিমূলক কথাও শুনতে হয়। মানসিক ভাবে হতাশাগ্রস্থ হওয়ার কারণে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষ থেকেই পিছিয়ে পড়ে।

আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: আগামী ৬ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইন ক্লাস শুরু

অথচ জিপিএ ভ্যালু না থাকলে তার জীবনের মোড় হয়তো পাল্টে যেত। আর যেখানে সব শিক্ষাবোর্ডের প্রশ্নভিন্ন সেখানে ভর্তিপরীক্ষায় জিপিএ ভ্যালু রাখাটা অহেতুক। শিক্ষামানের অগ্রযাত্রা এগিয়ে রাখতে হলে জিপিএ ভ্যালু অবশ্যই বাদ রাখা উচিৎ বলে মনে হয়। “

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট) এর শিক্ষার্থী, সাদিকাতুল বারী লাবিব জানান,“আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সবচেয়ে ভাল ও গ্রহন যোগ্য।আমাদের ৬০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হয়। বিস্তারিতভাবে একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই হয়।দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভেবে দেখতে পারে তারা এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে কি না।আমরা আমাদের পদ্ধতি নিয়ে সন্তুষ্ট।”

রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) এর শিক্ষার্থী, ইমন বলেন,আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মোটামুটি বেশ ভাল ছাত্র। কিন্তু এইসএসসি পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিতভাবে রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় সে অনেক জায়গাতে পরীক্ষাই দিতে পারে নাই।মেডিকেলে তার ১৭ নম্বর গ্যাপ থাকায় পরীক্ষা দিতেই চায় নি । নোবিপ্রবি তে ভর্তি পরীক্ষায় হয়তো সে প্রথম হতে পারত। কিন্তু জিপিএ তে ১০ মার্ক কম ছিল।তাই মেধাক্রমে থাকতেই পারে নি,পরে ওয়েটিং থেকেও ডাকলেও পছন্দমত সাবজেক্ট পায় নি। এমন আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে,শুধু সেই না আমার এমন আরও কিছু বন্ধু এমন পরিস্থিতির স্বীকার। তাই আমিও তাই এমন বৈষম্যমুলক পরিস্থিতির অবসান হোক।

আরও পড়ুনবরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় : ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কেন্দ্রীয় মসজিদের উদ্বোধন আজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, রনো আনোয়ার জানান “ভিন্ন ভিন্ন বোর্ডের প্রশ্নের কাঠিন্য ভিন্ন হয়ে থাকে,রেজাল্টেও রয়েছে পার্থক্য।সব বোর্ডের জিপিএ কে এক পাল্লায় মাপার কোন গাণিতিক যুক্তি থাকতে পারে না।ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থী ভাল নম্বর পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী চান্স পাচ্ছে না,অনেকে শীর্ষ পছন্দের বিভাগগুলোতে পড়তে ব্যর্থ।অবিলম্বে এই অসম পদ্ধতি পরিহার করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ইউজিসির ভাবা প্রয়োজন।”

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী, জান্নাতুল ফারজানা তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, “আমি সিলেট কৃষিতে ভালো পরিক্ষা দিয়েও অপেক্ষমান তালিকায় ছিলাম। রেজাল্ট এ ৩ মার্ক কম ছিলো বলে । যদি ৩ মার্ক কম না থাকতো তাবে চান্স পেতাম। ময়মনসিংহ এ বাড়ি থাকা সত্ত্বেও বাকৃবি তে পরিক্ষা দিতে পারিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ কম বলে। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ও অনেক নাম্বার কেটেছে, নয়ত ভালো প্রাইভেট মেডিকেলে হলেও স্কলারশিপের চান্স পেতাম। এরকম অনেক বৈষম্যের স্বীকার হয়েছি, অপেক্ষমান তালিকায় থেকেছি আর হতাশায় সেই ভয়ঙ্কর দিন গুলো কাটিয়েছি।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী, মোঃ আল-মামুন জনান “আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএ টাকে অনেক গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এখানে জিপিএর ভিত্তিতে প্রতি বিভাগ থেকে ৩০ হাজার শিক্ষার্থী বাছাই করে নেওয়া হয় এবং শুধু তারাই পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পায়। সর্বনিম্ন জিপিএ ৭.০০ (এসএসসি+এইচএসসি) ধরা হলেও বাস্তবে অনেক শিক্ষার্থীর জিপিএ ৭.০০ থাকার পরেও তাদের পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ হয় না।যেমনঃ গত ২০১৯-২০ সেশনে ক-বিভাগের বাছাইকৃতদের মধ্যে সর্বনিম্ন জিপিএ ছিল ৯.৬৩। প্রথম সিলেকশনে জিপিএর ভিত্তিতে যাদের বাতিল করে দেয়া হয় তাদের মধ্যেও অনেক মেধাবী থাকতে পারে বলে আমি মনে করি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএর গুণগত মান বিচার না করে সবাইকে সমান সুযোগ করে দেয়া উচিৎ।”

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতে যদি এমন নম্বর বিভাজন পদ্ধতি চালু থাকে তাহলে তাদের পক্ষে কি পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় বা পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা সুগোগ কি আদৌ সম্ভব?

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *