ভারত বনাম চীন: আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিতে কতটা দক্ষ বাংলাদেশ?

ভারত বনাম চীন: আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিতে কতটা দক্ষ বাংলাদেশ?

মোঃ আশরাফুল আলম আকাশ


স্বাধীনতা পরবর্তী “তলাবিহীন ঝুড়ি” মন্তব্যে থাকা বাংলাদেশ যে দরকষাকষির জায়গায় পরিণত হবে, এটা কি তৎকালীন সময়ে চিন্তা করেছিল কেউ?

৭৫ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অনেক চড়াই-উৎরাই পার করেছে। তারপরও যে বাংলাদেশ অাজকের চমকে পরিণত হবে এটা চিন্তা করাও বিরল।

মূলত ভারত-চীনের অর্থনৈতিক ও ভু-রাজনৈতিক বিরোধ বাংলাদেশ সৃষ্টিরও অনেক আগেই।হিন্দুস্তান-পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমেই মুলত চীনের প্রভাব বাড়তে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার।

ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া রাষ্ট্র দুটি নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে থাকে বৃটিশ কতৃক নির্ধারিত প্যাঁচানো বিরোধপূর্ণ ভুখন্ড নিয়ে।

ভারত সুকৌশলে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠে। ফলে সেই সময় পারমাণবিক শক্তিধারী চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যাথার কারণ যে ভারত সেটা ধরে নেয়াই যায়।
ঠিক সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় পাকিস্তান। সেই সময়েও চীন-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দী থাকলেও পাকিস্তানের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক বৃদ্ধি করে দেশ দুটি। অঘোষিতভাবে বলাই যায় সেই সুবাদেই পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে সমর্থ হয় ভারতকে মোকাবেলার জন্য।
সেই সময়েই তৎকালীন পাকিস্তান পুর্ববাংলায়ও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টা করে( বর্তমান বাংলাদেশের রুপপুরে)।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। অর্থাৎ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় পাকিস্তান পরোক্ষভাবে ভারতকে চাপে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঘুরে দাঁড়ায় ভারত। তাদের হাতে চলে অাসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মধুর প্রতিশোধ নেওয়ার সময়। অত্যন্ত সুকৌশলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে ভারত। ভারতের তৎকালীন বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়াও ভারতকে এবং বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে নানা উপায়ে।
মুলত যুদ্ধ বাংলাদেশ-পাকিস্তান হলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো এতে জরিয়ে পড়ে। যাই হোক বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। ৫০ বছরের বাংলাদেশে এখন দিনবদলের গান।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অনেক ভারসাম্য বজায় রেখে নিজের স্বার্থটি অাদায় করতে হয় অান্ঞ্চলিক ভু-রাজনৈতিক পরিবেশে।

পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক তেমন ভাল হয়। বানিজ্যও তেমন হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ব্ধাপরাধীদের বিচারের সরাসরি বিরোধীতা করে পাকিস্তান। ফলে কুটনৈতিক সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে। পাকিস্তানের সাথে আমাদের আসলে চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই এখন বলতে গেলে বরং পাকিস্তান এখন সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পিছনে। এটাই মনে হয়ে বড়
সফলতা।

বর্তমান পরিস্তিতিতে বন্ধু রাষ্ট্র ভারতও খুব একটা ভাল নেই। পাকিস্তান-চীন তো অাছেই তার সাথে ভুটান,নেপাল প্রায় সব প্রতিবেশী রাষ্টগুলোর সাথে ভারত বিবাদে জরিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে তারা পাশে পেতে চাইছে।

এদিকে স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ বিরোধী চীনও এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। তারা ভারত ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িযেছে। উদ্দেশ্যে কিন্তুু ভারতকে বশে রাখা। তাদের আরো একটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে শক্ত বলয় সৃষ্টি করা।

এখন আসি আমাদের দেশের কথায়।
ভু-রাজনৈতিক এই পরিস্থিতিকে অামাদের বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভারতের সাথে আমাদের রয়েছে ঐক্যের বন্ধন।

অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক, সাংষ্কৃতিক সহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে এই বন্ধন। বাংলাদেশ তার বন্ধু রাষ্ট্রের জন্য তাই কোন কিছু দিতে কখনো কার্পণ্য করেনি। বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে তারা স্থল ও পানিপথে ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে। তবুও কেন জানি বর্তমান সময়ে সম্পর্কে একটু হলেও ফাটল ধরেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

অাসামের বিতর্কিত নাগরিকত্ব অাইন পাশ, বিভিন্ন সময় ভারতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দ্বারা বাংলাদেশকে নিয়ে সমালোচনা, তিস্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে থাকা, সীমান্তে হত্যাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের জনমতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আসলে সত্য বলতে কি একপাক্ষিক ভালবাসায় যে কাজ হয়না তা বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতের পাশাপাশি চীনকেও আমাদের বিশেষ ভাবে দরকার। এর আগে চীন প্রায় ২০০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে আগ্রহী এবং এ ব্যাপারে চুক্তিও হয়েছে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, আমরা যেন চীনের জালেও অাটকে না যাই। অবশ্য সরকার তাদের বিনিয়োগের মাত্র ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে যাতে করে ঝণের বোঝা একেবারেই না অাসে। এটা এক ধরনের দক্ষতাই বলা চলে রাষ্ট্রের। চীনের সাথে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কোন সম্পর্কেই নেই ভারতের মতো।

তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ শক্তভাবেই গড়ে উঠেছে তার বড় প্রমাণ পদ্মাসেতু সহ দেশের বড় বড় প্রকল্পের চীনের অংশগ্রহণ। এতে ভারতের কিছুটা চিন্তা বিষয় হলেও অামি মনে করি, দেশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে কোন এক দেশের দিকে না ঝুঁকে সব রাষ্ট্রের সাথে সমন্বয় করে চলা। অাজকের এই সময়ে বাংলাদেশ খুব ভাল করেই জানে।

চীন-ভারত ভু-রাজনৈতিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে আমরা নিজেদের উন্নয়ন করবো। অামার দৃষ্টিতে বর্তমান সরকার সেই পথেই হাঁটছে।

ভৌগোলিকভাবে সুন্দর একটি জায়গায় বাংলাদেশ। আমরা অর্জন করেছি সমুদ্রের বিশাল অর্থনৈতিক জোন। সেটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে অামাদের। চীন-ভারতের এই দরকষাকষিতে অামাদেরকে নিজের লাভের জায়গাটা খুজতে হবে।

করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশ পাল্টে যেতে পারে। সেই সুযোগটাই আমাদের নিতে হবে। করোনা ভ্যাকসিন ইস্যুতে ২ দেশেই বাংলাদেশকে কাছে টানছে। অামদানী-রপ্তানি, শুল্ক মুক্ত পন্য রপ্তানিতে শুধু উক্ত ২ দেশেই নয় বরং বিশ্বের সব দেশের সাথে সুযোগ উন্মোচন করতে হবে আমাদেরকে। তবে অনেক সময় দুর্নীতি আমাদের রাষ্ট্রকে রুদ্ধ করে রাখে।

সুতরাং দুর্নীতির মতো বিষয়গুলোকে যদি আমরা দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে পারি তাহলে চীন-ভারত ভু-রাজনৈতিতে বাংলাদেশ হবে একখন্ড সোনা।

মোঃ আশরাফুল আলম আকাশ
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *