ভার্চুয়াল ট্যুরিজম: আবদ্ধ জীবনে ভ্রমণের স্বাদ

ভার্চুয়াল ট্যুরিজম: আবদ্ধ জীবনে ভ্রমণের স্বাদ

সাজু সরদার


বাংলাদেশ! বর্তমান বিশ্বে একটি বিস্ময়কর নাম। এ বিস্ময় বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ড কিংবা স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে নয় বরং বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা নিয়ে, বাংলাদশের অপার সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা নিয়ে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময় আর আমাদের অহংকার। এ অহংকার নেতিবাচক বা অমূলক নয়। এ অহংকার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি অর্জনের মনোবল।

আমাদের এ অহংকার তাদের জন্য শিক্ষা যারা এদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সাথে তুলনা করেছিলো, যারা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিলো। এ অহংকার থেকে তারা শিক্ষা পায় যারা একদিন “ডিজিটাল বাংলাদেশ” ধারণাকে কটাক্ষ করেছিলো। বর্তমান সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত তথ্য-প্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাকে বাস্তবে রুপদানের মাধ্যমে সকল কটাক্ষের জবাব দিয়েছে। আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা সকল শ্রেণীর মানুষের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ২০২০ সালের জুলাই মাসের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬৪ মিলিয়নের বেশি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এবং তারমধ্যে ১০৬ মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ও পোস্ট-ই সেন্টার থেকে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক সেবা পাচ্ছে, স্কুল-কলেজে আইসিটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইন্টারনেট সুবিধা বৃদ্ধির ফলে দেশে অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্যরও প্রসার ঘটেছে।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নতুন গতি সঞ্চর করেছে। যে গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, এক অদৃশ্য শত্রু সেই গতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সেই শত্রুর নাম করোনা ভাইরাস। যার শক্তির কাছে পুরো বিশ্ব আজ দিশেহারা। করোনা ভাইরাসের কারণে মানবজীবন থেকে শুরু করে শিল্প, সেবাসহ সকল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাত হলো পর্যটন খাত বা পর্যটন শিল্প। করোনা পরিস্থিতির কারণে সবার আগে পর্যটন খাতকে লকডাউন বা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবার সবার শেষে উন্মুক্ত করা হয়েছে বা হবে।

পর্যটন শিল্পকে ছাতার সাথে তুলনা করা হয় (Umbrella Concept)। একটি ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে যেমন আমরা বৃষ্টি কিংবা রোদ থেকে নিজেদের বাঁচায় তেমনি পর্যটন নামক ছাতাকে আশ্রয় করেই হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, পরিবহনের মতো বিভিন্ন সহযোগী খাত বেঁচে থাকে। কারণ মানুষ ভ্রমণ বা পর্যটনে বের হলেই হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, পরিবহন ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। করোনার পরিস্থিতির কারণে পর্যটনখাতের পাশাপাশি উল্লেখ্য সকল অংশীদারি বা সহযোগী খাত সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব খাতের সাথে জড়িত লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছে।

আপাতদৃষ্টিতে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো মনে হলেও পর্যটন খাতে এখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই এখনো কোথাও ঘুরতে যাওয়ার বদলে ঘরে থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। ঘরে বসেই মানুষ এখন স্বপ্ন দেখছে পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাবে, কোথায় থাকবে কিংবা কোন রেস্তোরাঁয় বসে একসাথে সকালের নাস্তা কিংবা দুপুরের এবং রাতের খাবার খাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি, বিভিন্ন অভিব্যক্তি এবং ছবি প্রমান করে করোনার এই পরিস্থিতিতে তারা ভ্রমনকে কতটা অনুভব করে এবং এই আবদ্ধ জীবনে কতটা অস্বস্তিতে আছে। তবে ভার্চুয়াল ট্যুরিজম এই আবদ্ধ জীবনের সমাধান দিয়ে কিছুটা হলেও ভ্রমনের স্বাদ বা স্বস্তি এনে দিতে পারে।

ভার্চুয়াল ট্যুরিজম একটি ইলেকট্রনিক বা অনলাইন ভিত্তিক পর্যটন কৌশল যার মাধ্যমে পর্যটকরা অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসে ভিডিও বা স্থিরচিত্রের মাধ্যমে ধারণ করা দর্শনীয় স্থানগুলির সৌন্দর্য ভার্চুয়ালি উপভোগ করতে পারে, ভ্রমণ সম্পর্কিত তথ্য অর্জন করতে পারে এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, ভ্রমণ সংস্থার (Travel Agency and Tour Operator) সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং ভার্চুয়ালি অনলাইন ভিত্তিক পর্যটন সম্পর্কিত সেবা গ্রহণ করতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই পর্যটকদের জন্য এমন ভার্চুয়াল ট্যুরের ব্যবস্থা আছে যার মাধ্যমে পর্যটকরা ঘরে বসেই কোন দর্শনীয় স্থানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে কিংবা প্রত্যক্ষ ভ্রমনের পূর্বেই পর্যটকরা ভ্রমণ স্থান এবং থাকার স্থান (হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট) ঘুরে দেখতে পারে।

করোনাকালে ভ্রমনপ্রিয় মানুষেকে চীন মহা প্রাচীর, পেরু মাচুপিচু ও জর্ডান পেত্রার সৌন্দর্য ভার্চুয়ালি উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ হলেও বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশে ভার্চুয়াল ট্যুরিজমের সকল উপাদান যেমন- ডিজিটাল ডিভাইস, ইন্টারনেট সংযোগ, ভ্রমণ এবং প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ বা উন্মাদনা বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ভার্চুয়াল ট্যুরিজমের তেমন কোন সুবিধা দেশে নেই বললেই চলে। ২০১৭ সালে তরুণ দম্পতি সফটওয়্যার প্রকৌশলী নাসির খান ও মুন রহমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঙালী জাতিসত্তা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তির ঠিকানা, বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিকে ভার্চুয়াল ট্যুরের (https://tour.bangabandhumuseum.org.bd/) আওতায় নিয়ে আসেন।

সরকারি পর্যায়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরকে প্রযুক্তি বান্ধব করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সহযোগিতায় ভার্চুয়াল ট্যুরের (https://vt.bnm.org.bd/) সুবিধা চালু করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের ভার্চুয়াল ট্যুরের সুবিধা এখনো বিদ্যমান। যাদুঘর দুটির ভার্চুয়াল ট্যুর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে যে কেঊ যাদুঘরের যে কোনও গ্যালারী বা স্থান দেখতে পারবে। বাংলাদেশের কিছু তারকা মানের হোটেলেও ভার্চুয়াল ট্যুরের সুবিধা চালু আছে। যার মাধ্যমে অতিথিরা হোটেলের সেবা গ্রহনের পূর্বেই উক্ত হোটেলের সুযোগ সুবিধাগুলো সম্পর্কে অবগত হতে পারে। ভার্চুয়াল ট্যুরকে প্রচার-প্রসারের কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। ভার্চুয়াল ট্যুরের মাধ্যমে কোন দর্শনীয় স্থান, হোটেল, মোটেল কিংবা রিসোর্টের সৌন্দর্য ও সুযোগ সুবিধা উপস্থাপন বা প্রচার করে পর্যটক কিংবা অতিথিদের আকৃষ্ট করা যায়। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার প্রতি পর্যটকদের বিশ্বাস জন্মে এবং তারা ভ্রমণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধি বা প্রসারে ভূমিকা রাখে।

ভার্চুয়াল ট্যুরিজম সুবিধায় দর্শনীয় স্থানের উচ্চ রেজ্যুলেশনের ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ করা হয় যা দেখার জন্য পর্যটকদের উচ্চগতির মানসম্মত ইন্টারনেট সংযোগ ও স্মার্ট ডিভাইসের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে স্মার্ট ডিভাইসের স্বল্পতা বা সমস্যা না থাকলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে। যে দেশে অনলাইনে ক্লাস করার জন্য শিক্ষার্থীদের গাছে কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হয় (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা) সে দেশে এমন বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক। তবে মানসম্মত ইন্টারনেট সমস্যার সমাধান করে ভার্চুয়াল ট্যুরিজম সুবিধা চালুর মাধ্যমে পর্যটন খাতের নতুন দ্বার উন্মোচন করা যায়। এর ফলে পর্যটকরা যেমন আবদ্ধ জীবনে বা স্বাভাবিক সময়ে (New Normal) ভ্রমণের স্বাদ পাবে, তেমনি ভ্রমণের পূর্বেই কোন দর্শনীয় স্থানের সৌন্দর্য ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অবগত হয়ে উক্ত স্থান ভ্রমণ করতে পারবে।

যার মাধ্যমে পর্যটক ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্থাপিত হবে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক এবং পর্যটন শিল্প হবে আরো সমৃদ্ধ। পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যয়ে মুজিব বর্ষেই ভার্চুয়াল ট্যুরিজমের দ্বার উন্মচনের মাধ্যমে “মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, নতুন করে পর্যটনের খুলবো দ্বার” এবং “ডিজিটাল বাংলাদেশ” স্লোগান দুটি সার্থক ও সফল হয়ে উঠুক।

সাজু সরদার
শিক্ষক
ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *