ভুল মানুষের প্রেমে

ভুল মানুষের প্রেমে

কাওসারী বেগম


ঢাকার মোটামুটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে প্রীতি। পরিবারের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সবার কাছে আদর টাও অন্য রকম। যখন যা চাইতো সেটাই পেতো। সবার আদরে অনেকটা একরোখা টাইপের হয়ে যায়।

এক সময় মেট্রিক পাস করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলো। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে অনেকটা নিজের মতো করে চলতে থাকে প্রীতি।পরিবারের কেউ এটা নিয়ে তেমন কিছু পাত্তা দিতো না। কখনো একা কখনো বান্ধবীদের নিয়ে যাতায়াত করে।

একদিন খেয়াল করলো প্রীতি ওর কলেজ যাওয়া আসার পথে প্রায়ই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ছেলেটা বেশ ফ্যাশনেবল, একেক দিন একেক পোষাক পড়ে আসে আর খুব স্টাইলিশ পোষাক। মাঝে মাঝে চোখে সানগ্লাস থাকে, কখনো বুক পকেটে দামী কলম।

ছেলেটা বেশ সুদশর্ন হওয়ায় প্রীতি মনে মনে তার প্রতি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। আচমকা একদিন ছেলেটি এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে প্রীতিকে প্রেম নিবেদন করে। প্রীতি মনে মনে আনন্দে নেচে উঠে কিন্তু ছেলেটিকে কিছু বলে না। এভাবে তিনদিন ছেলেটি একই কাজ করলো প্রীতির সাথে।

অবশেষে প্রীতি ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করে, ছেলেটি বলে ওর নাম সবুজ। এভাবে আস্তে আস্তে প্রীতি আর সবুজের সম্পর্ক এগুতে থাকে। সবুজের মার্জিত ব্যবহার আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট গিফট পেয়ে প্রীতি খুব দুর্বল হয়ে পড়ে।

সারাক্ষণ ওর কথাই ভাবে সারাদিন, লেখাপড়ায় ও মন বসে না ঠিকমতো। কথায় কথায় জানতে পারে সবুজের বাবার তিনতলা বাড়ি আছে আর ও একাই কোন ভাইবোন নেই। প্রীতি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী ভাবতে থাকে। কিছুদিন চলার পর দুইজনে সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করার।

কিন্তু প্রীতির বাবা-মা, ভাই এতো তারাতাড়ি প্রীতিকে বিয়ে দিবেনা। সবুজও বলে কেবল অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে এই মুহূর্তে বাড়িতে নিজের বিয়ের কথা বললে বাবা সোজা বের করে দিবে। দুই জনে অনেক ভেবে ঠিক করলো বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করবে, কিছুদিন দূরে থাকবে তারপর এক সময় দুই পরিবার মেনে নিবে। যেমন বয়স তেমন বুদ্ধি!!

প্রীতি একটা চিরকুট লিখে। মা, আমি চলে যাচ্ছি,আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি ভালোই থাকবো। আমাকে ক্ষমা করে দিও।তারপর সেটা ওর মায়ের বালিশের তলায় রেখে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়।

আজ দশদিন ধরে প্রীতি বাড়ি ছাড়া। তিনদিন হোটেলে থেকে সবুজ বন্ধুর বাড়ির কথা বলে বেগুনবাড়ির বস্তিতে উঠেছে। সাতদিন ধরে এখানেই আছে তারা। ফ্ল্যাট বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত প্রীতি বস্তির নোংরা পরিবেশ দেখে খুব বিরক্ত হয়ে যায়। এদিকে সবুজ ও কিছু করছে না।

এর মধ্যে সকাল থেকে এক মধ্য বয়সী মহিলা খুব জঘন্য ভাষায় সবুজকে গালিগালাজ করেই যাচ্ছে, সবুজও কিছু বলছে না। প্রীতি অসহ্য হয়ে ওই মহিলাকে কিছুটা রাগের স্বরে বলে , কেন সে সবুজকে এতো বাজে ভাষায় বকা দিচ্ছে। মহিলা জবাব না দিয়ে উল্টো প্রীতিকেই বাজে ভাষায় গালি দেয়া শুরু করে।

প্রীতির চোখে পানি এসে যায়, রাগে সবুজকে ধাক্কা দিয়ে বলতে থাকে কেন সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বলছে না কেন। সবুজ বলে, ওই মহিলা আমার মা আর আমরা এই বস্তিতেই থাকি। ঢাকায় আমাদের কোন বাড়ি নেই। আমার মা বাসা বাড়িতে কাজ করে আর বোন গার্মেন্টসে, তাদের আয় দিয়েই সংসার চলে।

এই সব শুনে প্রীতির মাথায় আচমকা আকাশ ভেঙে পড়ে। চিৎকার করে সবুজকে ধরে বলে, কেন আমাকে মিথ্যে বললে। সবুজ প্রীতির হাত ছাড়িয়ে বলে, নেশা করা আর জুয়া খেলা সবুজের পেশা। যার কাছ থেকে নেশা কিনতো সে বেশ টাকা পায় সবুজের কাছে, এদিকে মুদী দোকানেও বেশ বাকী পড়ে আছে৷ কিভাবে এইসব শোধ করবে চিন্তায় পড়ে যায়।

তখন বুদ্ধি করে কোন বড়লোকের মেয়েকে পটিয়ে বিয়ে করার। পারিবারিক অবস্থা দেখে তখন প্রীতিকে টার্গেট করা হয়। নিজেকে বড়লোকের ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে প্রতিদিন এলাকার লন্ড্রি থেকে দামী পোষাক নিয়ে প্রীতির কলেজ যাওয়া-আসার পথে দাঁড়িয়ে থাকতো।এইভাবেই প্রেম তারপর বিয়ে, কিন্তু প্রীতি হতাশ করে পালিয়ে আসার সময় বাবার বাড়ি থেকে কেবল ছোট একটা সোনার নেকলেস আনে। যা দ্বারা দেনা শোধ করা যায় নি।

সকাল বেলায় পাওনাদাররা এসে সবুজের মাকে বকাবকি করে যায়, যার জন্য সবুজের মা সবুজকে বকতে থাকে। সব শুনে প্রীতি চিৎকার দিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে, সবুজ সব বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

সন্ধ্যার পর সবুজ ফিরে প্রীতির সাথে বেশ রূঢ় আচরণ করতে লাগলো আর বললো দুইদিনের মধ্যে ওর বাবার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা যেন এনে দেয়। প্রীতি সবুজের কথায় বেশ ঘাবড়ে যায় কিন্তু কিছু বলে না। দুইদিন পর সবুজ টাকা চাইতেই প্রীতি জানায় ওর পক্ষে সম্ভব না আর বাবার বাড়ি যাওয়ার। সবুজ এই কথা শুনে সাথে সাথে প্রীতির কান বরাবর খুব জোরে চড় লাগায়। প্রীতি বেশ কিছুক্ষণ কানে কিছুই শুনতে পায়নি।

এরপর থেকে প্রায়ই সবুজ প্রীতি গায়ে হাত তোলে, প্রীতিও সব মুখ বুজে সহ্য করে নিতে থাকে। এক সময় সবুজের অত্যাচার কমে আসলো, প্রীতি ভাবলো হয়তো সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু প্রীতির জন্য আরো চমকের বাকী ছিলো।

মাস খানেক পরে এক সন্ধ্যায় প্রীতিকে বেড়ানোর কথা বলে নির্জন এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মাইক্রোবাসে তুলে দেয়। মাইক্রোবাসে থাকা একজন সবুজের দিকে এক বান্ডিল টাকা ছুঁড়ে দেয়। সবুজ টাকার বান্ডিল হাতে নিয়ে প্রীতির দিকে তাকিয়ে এক বিশ্রী হাসি দিয়ে বিদায় নেয়। প্রীতি বুঝতে পারে ওকে নারী পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে, সবুজের বিশ্বাসঘাতকতা দেখে চিৎকার দেয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে।

সপ্তাহখানেক পরে প্রীতিকে পাচারকারীরা বর্ডারের কাছে এক বাড়িতে এনে রাখলো। প্রীতি দেখলো ওর বয়সী বেশ কয়েকটা মেয়ে এই বাড়িতে। কেউ বিয়ের প্রলোভনে আবার কেউ চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এদেরকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করেছে। কয়েকটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলো ওদের সাথে, হয়তো রাস্তা থেকে চুরি করে এনেছে।

রাতের আঁধারে বর্ডার ক্রস করার সময় গোয়েন্দা পুলিশের এক চৌকস টিমের কাছে ওরা ধরা পড়ে। সবাইকে থানায় নিয়ে আসা হয়। পাচারকারীদের জেলে প্রেরণ করে মহিলা ও বাচ্চাদের একটা সেইফ হোমে রাখা হয়। তাদের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে বাবা-মায়ের কাছে খবর পাঠানো হয় আর বাচ্চাদের ছবি তুলে পত্রিকায় দেয়া হয়।

প্রীতির বাবা-মা থানায় যায়, মেয়ের জরাজীর্ণ চেহারা দেখে প্রীতির মা ডুকরে কেঁদে উঠে। প্রীতির বাবা মেয়েকে দেখামাত্র রাগে খুব বকাবকি করতে লাগলো, এরপর বললো তুই চলে যাওয়ার পর এক মাস তোর মা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি, তোকে কখনো শাসন করি নি তার প্রতিদান এভাবে দিলি, মুখে চুনকালি মেখে।

প্রীতির বাবার কথা শেষ হতেই ওসি উনাকে মেজাজ ঠান্ডা করতে বলে আর বোঝায়, কম বয়সে আবেগ বেশী থাকে ফলে যা হবার তাই হলো। আপনাদের মেয়ে আরো বড় বিপদে পড়তে পারতো। যদি কোন পতিতা পল্লীতে বিক্রি হয়ে যেত তবে হয়তো কখনোই আর খোঁজ পাওয়া যেত না। এখন ভুল শুদরে ওকে বাকী জীবন ভালোভাবে চলতে আপনাদের সাহায্য ওর অনেক প্রয়োজন।

ওসির কথা শেষ হতেই প্রীতির মা দাঁড়িয়ে উঠে বলতে থাকে, জীবনের কিছু ভুল যা কখনো শোধরায় না। আমরা সমাজ নিয়ে বাস করি, এখন ওকে নিয়ে গেলে আমরা সমাজের কাছে সব সময় অপমানিত হবো। তার চেয়ে আপনারা যা ইচ্ছা ওকে তাই করুন, আমাদের কোন মেয়ে নেই। একজন ছিলো সে অনেক দিন আগে মরে গেছে। এই বলে প্রীতির বাবা-মা চলে যায়।

ওসি অনেক চেষ্টা করে তাদের বুঝাতে সক্ষম হতে পারিনি। প্রীতি কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে এর চেয়ে ভালো ছিলো পাচার হয়ে যাওয়া। ওসি তখন আশ্বাস দিলো, নিজেকে আরো শক্ত করো, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। একটা ব্যবস্থা হবেই। প্রীতি কাঁদতে কাঁদতে জানতে চায় যারা মেয়েদের পাচার করে তাদের জীবন নষ্ট করে তাদের কি কোন শাস্তি হবে কিনা।

ওসি বলে, পাচারকারীদের হাত অনেক বড় যারা স্পটে ধরা পড়ে শুধু তাদেরই শাস্তি হয় কিন্তু এর মূলে যারা আছে তাদের শাস্তি তো দূরে গ্রেফতারই করা যাবে না। এদের কেউ কেউ রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ে, কেউ বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত আবার কেউ কেউ বিভিন্ন সভায়, সেমিনারে নারী অধিকার নিয়ে গলা ফাটায়।

প্রীতির বাবা-মা প্রীতির দায় এড়াতে পারলেও রাস্ট্র পারেনি দায় এড়াতে। অবশেষে প্রীতির নতুন ঠিকানা হয় “দুস্থঃ মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্রে”। প্রীতি এখানে এসে দেখে ওর মতো অনেক মেয়েরা এই কেন্দ্রে আছে, তাদের অনেকেই প্রেমিক দ্বারা প্রতারিত।

এই কেন্দ্রে মহিলাদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রীতি সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে কেন্দ্রের পরিচালকের সহায়তায় এক সময় ছোট একটা দোকান দেয়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই দোকান থেকে এক সময় বিশাল শো রুম দিতে সামার্থ্য হয় যার বেশীর ভাগ কর্মচারী হয় দুস্থ মহিলারাই। পাশাপাশি দেরি করে হলেও গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে। কিন্তু অভিমানী, একরোখা প্রীতি আর কখনো বাবা-মার কাছে ফিরে যায় নি।

কাওসারী বেগম, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *