যেভাবে হানাদার মুক্ত হয় নোয়াখালী

যেভাবে হানাদার মুক্ত হয় নোয়াখালী

মো: রিয়াদ হোসেনঃ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের এদিনে দখলদার পাকিস্থানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোশরদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিলো অবিভক্ত নোয়াখালী। যদিও ৬ ডিসেম্বর ফেনী ও বেগমগঞ্জের কিছু এলাকা মুক্ত হয়। তবে ৭ ডিসেম্বর ভোর রাত থেকে বা প্রত্যুষে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা বিএলএফ প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত এবং সি জোনের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোশারেফ হোসেনের নেতৃত্বে জেলা শহর মাইজদী আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধারা।

সেদিন একযোগে তাঁরা তিনটি রাজাকার ক্যাম্প দখল করেন। ফলে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানিদের এদেশীয় দালাল রাজাকারেরা। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং একপর্যায়ে নোয়াখালী পিটিআইয়ের ট্রেনিং সেন্টার থেকে তড়িঘড়ি করে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকিস্থানী বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। সেদিন রাতেই (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ সকালবেলা মাইজদি শহরের নোয়াখালীর সকল পর্যায়ের রাজনৈতিক, সংস্কৃতিকসহ পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে একসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল, নুরুল হক, শহীদ এস্কেন্দার (কচি), অধ্যাপক মো: হানিফ, আব্দুর রব উকিল, রফিক উল্লাহ কমান্ডার, সাখাওয়াত উল্লাহ, রফিক উল্লাহ, ফখরুল হাসান, তৎকালীন জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল করিম, পুলিশ সুপার আব্দুল হাকিম, এ.ডি.সি. ক্যাপ্টেন আনিসুর রহমান,সদর মহকুমা প্রশাসক আইয়ুব আলীসহ আরও অনেকে।

সভাশেষে নোয়াখালীর টাউন হলে আব্দুল মালেক উকিলকে আহবায়ক করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মাইজদি পি.টি.আই, চৌমুহনী, সোনাইমুড়ি,চাটখিলসহ বেশ কিছু স্থানে সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ট্রেনিং শুরু হয়। ২২ এপ্রিল সর্বপ্রথম নোয়াখালীতে পাকিস্তান সেনাবহিনী প্রবেশ করে। এরপর জেলা শহরের শ্রীপুর সোনাপুর , সদরের রামহরিতালুক, গুপ্তাংক , বেগমগঞ্জের কুরিপাড়া, গোপালপুর ও আমিশ্যাপাড়ায় নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়।

এ সময় হায়নাদাররা গুলি ও পুড়িয়ে হত্যা করে দ নারী-পুরুষ ও শিশুসহ সাধারণ মানুষদের। গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মুক্তিযোদ্ধার পাকিস্তানী হানাদারের পাশাপাশি দেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সাথেও যুদ্ধ করে। মুক্তিবাহিনী কোম্পনীগঞ্জের বামনী, তালমাহমুদের হাট, ১২ নং স্লুইস গেইট, সদরের ওদারহাট, করমবক্স, বেগমগঞ্জের ফেনাকাটা পুল, রাজগঞ্জ, বগাদিয়া, ওদারহাট, রাস্তারমাথা, গোপালপুরসহ আরও অনেক স্থানে পাকিস্তানী ও তাদের দালাদের সাথে যুদ্ধ করেন।

এরই ধারাবাহিতায় তারপর ৭ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি মাইজদি পিটিআই মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধের মুখে অবস্থা বেগতিক দেখে নোয়াখালী পিটিআইয়ের ট্রেনিং সেন্টার থেকে তড়িঘড়ি করে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা এবং মুক্ত হয় নোয়াখালী।

উল্লেখ্য নতুন প্রজন্মের কাছে ৭ ডিসেম্বরের স্মৃতিকে পরিচয় করিয়ে দিতে ১৯৯৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর তৎকালীন পাকবাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত নোয়াখালী পিটিআইয়ের সম্মুখে স্থাপন করা হয় স্মরণিক স্তম্ভ “মুক্ত নোয়াখালী”। পরবর্তীতে একই স্থানে বর্ধিত পরিসরে নোয়াখালী মুক্তমঞ্চ স্থাপন করা হয়।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগ,
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *