রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: গৌরবের ৬৮ বছর

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: গৌরবের ৬৮ বছর

আনন্দ কুমার সাহা

১৯৫৩ সালের ৩১শে মার্চ পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাশ হয়। গভর্নরের অনুমোদনের পর ১৯৫৩ সালের ১৬ই জুন ঢাকা গেজেটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তথ্যটি প্রকাশিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্টের কার্যক্রম শুরুর জন্য সরকার প্রফেসর ড. ইতরাৎ হোসেন জুবেরীকে একই বছরের ৬ই জুলাই উপাচার্য নিয়োগ করেন। পদ্মা তীরবর্তী ওলন্দাজ বাণিজ্য কেন্দ্র ‘বড়কুঠি’-তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৫৪ সালে ৫ জন ছাত্রী ও ১৫৬ জন ছাত্র নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক যাত্রা শুরু করে। শুরুতে রাজশাহী কলেজের বিভিন্ন ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৬৪ সালের মধ্যে বর্তমান মতিহার ক্যাম্পাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি অনুষদ।

জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদ সম্প্রতি ২টি অনুষদে বিভক্ত হয়েছে। মনোবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি এবং চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান নিয়ে গঠিত হয়েছে ফ্যাকাল্টি অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস। ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা এবং ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ নিয়ে গঠিত হয়েছে ফ্যাকাল্টি অব জিও সায়েন্সেস।

লেখকের আরও লেখা

ড. শামসুজ্জোহা

আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকাটা আনন্দের

গত ২৭.০৬.২০২০ তারিখে সিন্ডিকেট সভায় আরও ২টি অনুষদ অনুমোদিত হয়েছে। কৃষি অনুষদ থেকে ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস এবং ফিশারীজ অনুষদ সৃষ্টি হয়েছে। ৬টি ইনস্টিটিউটসহ মোট ৫৮টি বিভাগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

ইনস্টিটিউট

জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় উচ্চতর গবেষণা ও পরিচর্যার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি ইনস্টিটিউট শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হচ্ছে: ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (১৯৭৪), ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (১৯৮৯), ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স (২০০০), ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (২০০০), ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (২০০০) এবং ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ এন্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজেস (২০১৫)।

ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এ্যাসুরেন্স সেল এবং সেন্টার অব এক্সেলেন্স ইন টিচিং এন্ড লার্নিং: এই প্রতিষ্ঠান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সংযুক্তের সংখ্যা শিক্ষক-১২২১ জন (প্রফেসর ৬০৪, সহযোগী ২৯৭, সহকারী ২৩০, প্রভাষক ৯০ জন), অফিসার-৮০৫ জন, সহায়ক কর্মচারী-৭১৪ জন, সাধারণ কর্মচারী-১২২৯ জন এবং শিক্ষার্থী-৩৮,৩০০ জন ও বিদেশী শিক্ষার্থী-৫৮ জন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতীক

মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপরই গোলাম সারওয়ারের আঁকা মূল নকশা নির্বাচনের পর কিছুটা পরিবর্তন করে বর্তমান প্রতীকে রূপ দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী হাশেম খান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকে রয়েছে একটি বৃত্ত। তা বিশ্বের প্রতীক। একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ যা জ্ঞানের প্রতীক এবং আকাশ দৃষ্টি থেকে শাপলা ফুল সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও জাতীয় প্রতীক। এটি সূর্য অর্থেও প্রাণ ও শক্তির উৎস। প্রতীকের রং: বৃত্ত ও মূল গ্রন্থ কোবাল্ট ব্রু। তা আকাশ, নদী ও উদারতার রং। গ্রন্থের বহিঃরেখা রক্তলাল, জাতীয় পতাকার রং। গ্রন্থের মধ্যরেখা সোনালি, সোনার মতোই মূল্যবান শিক্ষার গুণগত মূল্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রতীকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে নকশা আহ্বান করা হয়। শিল্পী গোলাম সারোয়ারের আঁকা মূল নকশা নির্বাচনের পর কিছুটা পরিবর্তন করে বর্তমান প্রতীকে রূপ দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী হাশেম খান।

শিক্ষা কার্যক্রম শুরু

১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ১৬১ জন (১৫৬ জন ছাত্র এবং ৫ জন ছাত্রী)। বর্তমানে সকল বিভাগে বিভিন্ন বর্ষে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৮ হাজার ৩০০ জন এবং বিদেশী শিক্ষার্থী ৫৮ জন। প্রতিষ্ঠার গত ৬৮ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২,৬৫০ জন শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ১,৯৪৬ জনকে পিএইচডি এবং ৭০৪ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয় (২০২০ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত)।

মুক্তিযুদ্ধ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ অংশগ্রহণ করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর শামসুজ্জোহা শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালনকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হলে আইয়ূব খানের পতন ত্বরান্বিত হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষক (গণিত বিভাগের হবিবুর রহমান, মনোবিজ্ঞান বিভাগের মীর আব্দুল কাইয়ূম এবং ভাষা বিভাগের সুখরঞ্জন সমাদ্দার) এবং ৫ জন সহায়ক কর্মচারী, ১০ জন সাধারণ কর্মচারী ও ৯ জন ছাত্র শহীদ হন। এছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অজ্ঞাত আরও অনেকে এদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছে। এখানে শিক্ষকতা করেছেন ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, ইতিহাসবিদ ডক্টর এ.আর. মল্লিক ও জাতীয় অধ্যাপক এ.এফ. সালাহউদ্দীন আহমেদ। তাঁদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

৬ই জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস। কোভিড-১৯ এর কারণে এ বছর তেমন কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। তারা অনুপস্থিত। ইতোমধ্যে আমরা কোভিড-১৯ এর কারণে অনেককেই হারিয়েছি। আর হারাতে চাই না। বিশ্ববিদ্যালয় আবার ফিরে পাবে তার প্রাণ। এই হোক আজকের প্রার্থণা। #রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের ৬৮ বছর।

লেখকঃ উপাচার্য (রুটনি দায়ত্বি) ও উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *