শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

ড. আনন্দ কুমার সাহা

১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকতসহ অনেকেই। তাই এই দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত আছে। ২০১০ সাল থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা :
১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশের হাত ধরে সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের। তমদ্দুন মজলিস ১৫ সেপ্টেম্বর একটি পুস্তিকা বের করে যার শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা- না উর্দু?’ ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে বাংলাকে গণপরিষদে ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান গণপরিষদ তার প্রস্তাব গ্রহণ না করায় পূর্ব বাংলায় শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। ২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক নাগরিক সংবর্ধনায় ঘোষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” উপস্থিত ছাত্র জনতা প্রতিবাদ করে। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্পষ্ট করে বলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সমাবেশ স্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং নো নো বলে অনেকে প্রতিবাদ করে।

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয় ১৯৫২ সালে। খাজা নাজিমুদ্দিন ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, মিছিল ও সামাবেশের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালিন সরকার মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৪৪ ধারা জারি করে।

এ সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানায় আবদ্ধ। জেলখানার মধ্যে অনশন শুরু করেন এবং গোপনীয়ভাবে সার্বক্ষণিক সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়।

ছাত্ররা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ছাত্ররা মিছিল নিয়ে গণপরিষদের দিকে এগোতে থাকলে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস পরবর্তিতে গুলি করে। পুলিশের গুলিতে রফিকউদ্দিন ও আবুল বরকত নিহত। বহু আহত ছাত্রদেরকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বহু ঘটনার পর ১৯৫৬ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয় সংসদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই বছরে ৩ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী পাকিস্তানের সংবিধান কার্যকর হয়।

জাতিসংঘে কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচটি ভাষায়। সব দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত প্রতিনিধিরা পাঁচটি ভাষার মধ্যে যেকোন একটি ভাষায় কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণদান করার ফলে বিশ্বব্যাপী জানতে পারে বাংলা ভাষার মহত্ব।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
কানাডায় বসবাসরত রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে।

১৯৯৮ সালে ২০শে জানুয়ারি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়- অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করতে হবে। জনাব রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান।

এই সংগঠনের মাধ্যমে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান-কে আবারও চিঠি দেয়া হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি আনা মারিয়ার পরামর্শ অনুযায়ী ৫টি দেশ- কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়।

কানাডা থেকে রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য গর্বের বিষয় মনে করে মন্ত্রণালয় অতি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর অফিসে অনুমতি চেয়ে নোট পাঠায়। বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময় স্বল্পতার বিষয়টি উপলব্ধি করেন। তিনি সব ধরনের জটিলতা উপেক্ষা করে নথি অনুমোদনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ছাড়াই ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে সরাসরি প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দেন। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনের পক্ষে এর সচিব অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমদের স্বাক্ষরিত সেই প্রস্তাবটি প্যারিসে পৌঁছায়।

১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ১৮৮ দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ এ মর্মে একটি প্রস্তাব পাস হয়।

লেখক
প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা
উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *