শহীদ বুদ্ধিজীবী হবিবুর রহমান

শহীদ বুদ্ধিজীবী হবিবুর রহমান

প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা


১৫ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের আরও একটি শোকের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক প্রফেসর ড. হবিবুর রহমান পাকিস্তানী বর্বর সেনাদের হাতে নিহত হন। তিনি মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। শহীদ অধ্যাপক হবিবুর রহমানের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

হবিবুর রহমান জন্মেছিলেন ১৯২১ সালের ১লা জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার বালিয়াধার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া, মায়ের নাম সিদ্দীকা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে হবিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়।

বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে বটগ্রামের কাছে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন হবিবুর রহমান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সে সময় প ম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। স্কুল জীবনে বৃত্তির টাকা এবং ছাত্র পড়িয়েই নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন তিনি। নিজের অদম্য আগ্রহ ও অধ্যবসায়ের জোরে হবিবুর রহমান অজপাড়াগাঁ থেকে উচ্চশিক্ষার শিখরে উঠতে পেরেছিলেন।

হবিবুর ১৯৩৮ সালে নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার ‘দত্তপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। সেই সময়ে পাঁচ বিষয়ে লেটার পাওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। এরপর হবিবুর ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে আই.এস-সি পাস করেন এবং একই বছর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগে বি.এস-সি অনার্স শ্রেণিতে। তিনি ১৯৪৩ সালে অনার্স ডিগ্রি পান। এরপর তিনি এম.এস-সি শ্রেণিতে ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি রেকর্ড নম্বরসহ গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম.এস-সি ডিগ্রি পান।

হবিবুর রহমানের এই অসাধারণ ফলাফলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ও প্রখ্যাত গণিত বিশারদ স্যার জিয়াউদ্দীন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের কাছে হবিবুর রহমানকে স্টেট স্কলারশিপ ও চাকরি দেওয়ার জন্য বিশেষ সুপারিশ করে চিঠি দেন। ১৯৪৬ সালে হবিবুর রহমান প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি বদলি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। এরপর তিনি বদলি হন ঢাকা কলেজে এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সেখানেই শিক্ষকতা করেন।

১৯৫৪ সালের নভেম্বরে হবিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে ট্রাইপস ডিগ্রি পান। এরপর ১৯৫৮ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) পদে উন্নীত হন। ১৯৬২ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ফলিত গণিতের বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ফিরে এসে ১৯৬৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন। পরের বছর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলের প্রাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন হবিবুর রহমান বিয়ে করেন ওয়াহিদা রহমানকে। কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির হবিবুর রহমান পারিবারিক জীবনে ছিলেন সম্পূর্ণ অন্যরকম একজন মানুষ। গল্পগুজবে মাতিয়ে রাখতেন ছেলেমেয়েদের, কবিতা শেখাতে গিয়ে নিজেই কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন, খেলার ছলে অঙ্ক শেখাতেন। সন্তানদের তিনি বলতেন, “জ্ঞান একটি প্রজ্বলিত শক্তি, যা আলোকিত করে নিজেকে এবং সমাজকে।”

সততা, আদর্শ, মূল্যবোধ ও নিয়মনিষ্ঠার সমন্বয়ে একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন হবিবুর রহমান। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এর প্রতিবাদে পরিচালিত বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হবিবুর রহমান। তাঁর সুপরিকল্পিত নির্দেশনাতেই ড. জোহার মৃত্যুর পর পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় আহত-নিহতদের খোঁজখবর নেওয়ার কাজটি সুসম্পন্ন হয়েছিল।

বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর বইগুলো হলো : স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য ‘যোগাশ্রয়ী বীজগণিত’, স্নাতক শ্রেণির জন্য ‘কলেজ বীজগণিত’, স্কুলের জন্য ‘নতুন বীজগণিত’ এবং ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ‘পাটীগণিত’। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য রচিত বই দুটি সেসময় অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ও নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে : On Pell’s Equation’, ‘On Fermat’s Last Theorem’, ‘On Crisis of Civilization’ (1950), ‘On fundamental Human Rights’ (1969,‘নতুন শিক্ষানীতি’ (১৯৬৯) এবং ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ (১৯৭০)। শিক্ষা সংস্কারেও তিনি অত্যন্ত সাহসী ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছিলেন।

প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহযোগ আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার খবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতেই শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে চলে যেতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ে। তাঁর সহকর্মী, বন্ধু এবং পরিচিত অনেকে তাঁকে সে সময় অনুরোধ করে ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে। কিন্তু সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে হবিবুর রহমান ক্যাম্পাসেই থেকে যান।

১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল বিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে হবিবুর রহমানকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় তাঁর পরনে লুঙ্গি, গায়ে শার্ট এবং গলায় চাদর ছিল। অস্থায়ী সামরিক হেড কোয়ার্টার ‘বিশ্ববিদ্যালয় অতিথি ভবনে’র ছাদের উপরে সামরিক অফিসারদের সামনে হাজির করা হয় হবিবুর রহমানকে। এরপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সেদিনই অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়।

শহীদ হবিবুর রহমান ও স্ত্রী ওয়াহিদা রহমানের সংসারে দুই ছেলে ও চার মেয়ে। তাঁরা হলেন: মো. খায়রুল এনাম, আনিসুর রহমান, রোকসানা রাজ্জাক, শারমীন রহমান চৌধুরী, নাসরিন রহমান মোল্লা ও মোনালিসা হাসান। হবিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ওয়াহিদা রহমান প্রচ- পরিশ্রম করে ছয় সন্তানকে মানুষ করেছেন। এক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সামান্য কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেছে। ওয়াহিদা রহমান ২০০২ সালে মারা যান।

শহীদ হবিবুর রহমানের স্মৃতিকে ধরে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘শহীদ হবিবুর রহমান হল’। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে।

লেখকঃ উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *