শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা জাতির জন্য অশনি সংকেত

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা জাতির জন্য অশনি সংকেত

মুহম্মদ সজীব প্রধান


যেকোনো দেশ ও জাতির উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের এগিয়ে চলায় শিক্ষার্থীদের অবদান অপরিসীম সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বস্তুত, শিক্ষার্থীরাই আজ ও আগামির বাংলাদেশ এবং দেশের কর্ণধার। দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ অংশ যদি হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভুল পথে পা বাড়ায় তাহলে সমগ্র জাতির এগিয়ে চলা নিয়ে সৃষ্টি হবে সংশয়।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন ভুল ও ব্যর্থতায় জর্জরিত আর এর পরিমান যখন মাত্রাতিরিক্ত হয় তখন অনেক শিক্ষার্থী নিজের জীবন জলাঞ্জলি দিতেও দ্বিধা করেন না।

বিভিন্ন গবেষকের প্রাপ্ত উপাত্ত মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার শিকার যাদের অধিকাংশই উড্ডীয়মান তরুণ তরুণী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু মানুষ কেন এতোটা নির্দয় হয়ে নির্দিধায় নিজেকে মৃত্যুর কাছে সপে দেন? এর কারণ অনেক তন্মেধ্যে প্রধান কারণ হলো বিষণ্ণতা যা একটি ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ৫ জনের ১ জন মানুষ কোনো না কোনো ধরনের বিষণ্ণতা বা এনজাইটিতে ভুগছেন। বিষণ্ণতার সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে আক্রান্ত রোগীরা নীরবে-নিভৃতে আত্মহত্যা করে বসেন।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় শতকরা ৭০ ভাগ আত্মহত্যার কারণই বিষণ্ণতা। বিশ্বের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন। বাংলাদেশের শতকরা ১৮ থেকে ২০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনো প্রকারের বিষণ্ণতায় ভুগছেন।

বিষণ্ণতার পরে তরুণ তরুণীদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ প্রেমে ব্যর্থতা। যদিও প্রেম ভালবাসা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালবাসার এ বন্ধনে ফাটল দেখা দেয় তখন প্রিয়জনের শূণ্যতা মেনে নিতে না পেরে অনেকেই আত্মহত্যার পথকে বেছে নেন আর এমন উদাহরণ অহরহ।

এছাড়াও আমরা দেখতে পাই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর আত্মহত্যার হিরিক পড়ে আর এ কাতারে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী থেকে বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থী সবাই অন্তর্ভুক্ত।

অন্যদিকে, গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে মোট আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই মেয়ে। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হলো: নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, ধর্ষণ ইত্যাদি। সমাজে একজন মেয়ে যখন প্রতিনিয়ত ইভটিজিং ও হুমকির স্বীকার হন তখন সে মানসিক অস্থিরতা ও অসুস্থ্যতায় কাতরাতে থাকে।

তাছাড়া, বর্তমানে ধর্ষণ সামাজিক ক্যান্সারে রূপ ধারণ করেছে যার কারণে মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতাও কয়েকগুণ বেড়েছে। অধিকাংশ ধর্ষিত মেয়ে সমাজ থেকে নিজের নাম চিরতরে মুছে দিয়ে নিজেকে কলঙ্ক মুক্ত করার পন্থা হিসেবে আত্মহত্যার কথা ভাবেন। তাছাড়া তীব্র মাদকাসক্তি, অপরাধ বোধ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অভাব অনটন, মা-বাবার ওপর অভিমান ইত্যাদি আত্মহত্যার বড় ধরণের কারণ।

সত্যিকার অর্থে, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয় বরং বহু সমস্যার সূত্রপাত ঘটায় আর শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা মানে সমগ্র জাতিকে গলা টিপে হত্যা করা কেননা শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো দেশ ও জাতি। অন্যদিকে, যে পরিবারের একজন সদস্য আত্মহত্যার মতো কলুষিত পথে পা বাড়ান সে পরিবারকে আজীবন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা পোহাতে হয়। শুধু তাই নয় সমাজের হতাশাগ্রস্ত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্তরাও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে অনুপ্রাণিত হয়।

একটি আত্মহত্যা পুরো সমাজে এর বিষ বাষ্প ছড়িয়ে দেয় অর্থাৎ আত্মহত্যা সমাজ হত্যার নামান্তর। পবিত্র ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যার ভয়াবহ শাস্তির ব্যাপারে হুশিয়ারি রয়েছে। ইসলাম ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মেও আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তাই আত্মহত্যাকে সমাজ থেকে দূর করা অপরিহার্য আর এজন্য প্রথমেই সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিটি সমাজ হতে হবে সুস্থ্য সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র যেখানে সর্ব স্তরের মানুষ চিত্তবিনোদনের সুযোগ পাবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখতে হবে, প্রয়োজনে মানসিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।

পরিবারে প্রত্যেক সদস্যের প্রতি প্রত্যেক সদস্যের শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নজরদারি রাখতে হবে। এক্ষেত্রে পিতা মাতাকে বিশেষ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে অর্থাৎ সন্তানের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করতে হবে, তাদের ওপর কোনো কাজ জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সন্তানের ব্যর্থতায় তাকে বকাঝকা না করে সাহস ও উৎসাহ জোগাতে হবে।

নারী ও মেয়ে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলার প্রবণতা সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বস্তুত, সরকারের তৎপরতা ও সামাজিক সচেতনতার সমন্বয় হলেই সৃষ্টি হবে একটি আদর্শ সমাজ যেখানে থাকবেনা আত্মহত্যার মতো সামাজিক অভিশাপ।

পরিশেষে, যারা হতাশাগ্রস্ত বিষণ্ণতায় বিভোর তাদের জন্য বিশ্বকবির কবিতার দুটি পঙক্তি, “মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে,
হারা শশীর হারা হাসি, অন্ধকারেই ফিরে আসে।”

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *